নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রাথমিকভাবে নিবন্ধনযোগ্য তালিকায় থাকা বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষক সংস্থার অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। যশোর থেকে কুমিল্লা, নাটোর থেকে রাজশাহী—দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাগজে-কলমে যেসব সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য যোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের অনেকটির ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেছে ভাঙাচোরা ভবন, চায়ের দোকান, মুদি দোকান বা তালাবদ্ধ অফিসঘর। কোথাও আবার শুধু সাইনবোর্ড থাকলেও কার্যক্রম নেই।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ইসি দেশের ৭৩টি বেসরকারি সংস্থাকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ২৭টি সংস্থা। তবে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়ে সাংবাদিকরা বেশ কয়েকটির অস্তিত্বই পাননি।
যশোরে সীড-এর ঠিকানায় জঙ্গলঘেরা ভাঙা ভবন
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার দিঘিরপাড় বাজারের কাছে জঙ্গলে ঘেরা একটি ভাঙাচোরা ভবনে সার্ভিসেস ফর ইকুয়িটি অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (সীড)-এর প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া আছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় বহুদিন মানুষের যাতায়াত নেই। ভবনের কক্ষগুলোতে দরজা-জানালা নেই, মেঝেতে পানি জমে রয়েছে আর পুরনো আসবাবপত্রে ঘুণ ধরে ভেঙে পড়েছে।
ঢাকায় তিনটি সংস্থার নেই কোনো অস্তিত্বই
ঢাকার মিরপুরের দক্ষিণ পীরেরবাগে ঠিকানা দেওয়া বাসাবো জনকল্যাণ সংস্থা (বিজেএস)-এর কার্যালয় মেলেনি। সেখানে শুধু একটি নির্মাণাধীন ভবন পাওয়া যায়। মাদারীপুরে এ সংস্থার নাম থাকলেও কোনো কার্যক্রম নেই।
মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে ঠিকানা দেওয়া বিয়ান মনি সোসাইটি (বিএমএস)-এর অস্তিত্ব নেই। একইভাবে উত্তর আদাবরের অসম্পূর্ণ ঠিকানায়ও কোনো সংস্থার সন্ধান মেলেনি।
তবে মিরপুর রূপনগরে একটিভ এইড ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন নামে একটি ছোট অফিস পাওয়া গেছে।
পুরানা পল্টন ও সেনপাড়ার অফিস
পুরানা পল্টনের বায়তুল খায়ের ভবনে বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ইকোলজিক্যাল রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (বিএসইআরআই)-এর অফিসে মূলত একটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছে।
কাফরুলের সেনপাড়ায় পাথওয়ে নামের সংস্থা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের বায়তুল আমানে সমাহার–মাল্টিডিসিপ্লিনারি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থাকার দাবি করেছে।
মুদি-চায়ের দোকান হলো ইসিয়া অফিস
ঢাকার ধামরাইয়ের বাসনা গ্রামে ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভ ফর সোসিও ইকোনমিক অ্যাকটিভিটি (ইসিয়া)-র ঠিকানা পাওয়া গেছে মুদি ও চায়ের দোকানে। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থা ২০১৭ সালের পর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
নাটোরে পশু-পাখির আবাস
নাটোরের বড়াইগ্রামে আবাস নামে একটি সংস্থার কার্যালয় এখন পশু-পাখির আশ্রয়স্থল। স্থানীয়রা এর কোনো কার্যক্রমের কথা জানেন না। নাটোর পৌর এলাকায় আরেক সংস্থা সাথী পরিচালিত হচ্ছে সাধারণ সম্পাদকের নিজ বাড়ির নিচতলায়।
যশোরে অনিয়মের অভিযোগ
যশোরের দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে সরকারি প্রকল্পে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। তবে তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতার কথা দাবি করেছে।
ঝিনাইদহে নামসর্বস্ব সংস্থা
ঝিনাইদহে তিনটি সংস্থা—আলোকিত সমাজকল্যাণ সংস্থা, এসিয়া ও হেভেন। প্রাথমিক তালিকায় থাকলেও কার্যক্রমের প্রমাণ মেলেনি একটি সংস্থারও।
জয়পুরহাটে তালাবদ্ধ এমএসকে
জয়পুরহাটের সীমান্তবর্তী কোমপুর এলাকায় মানব সহায়ক কেন্দ্র (এমএসকে)-র প্রধান কার্যালয়ে তালা ঝোলানো। স্থানীয়রা জানেন না, এ সংস্থা কী কাজ করে।
ঝালকাঠিতে হিলফুল ফুজুল
কাগজে-কলমে ঝালকাঠির ভৈরবপাশায় ঠিকানা থাকলেও হিলফুল ফুজুল সমাজকল্যাণ সংস্থার অফিস চালু আছে শহরের কলেজ মোড়ে। এখানে কোনো সাইনবোর্ড নেই।
রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা
কিশোরগঞ্জের র্যাক-বাংলাদেশ পরিচালনা করছেন এক বিএনপি-জামায়াত নেতার ভাই। নরসিংদীর অগ্রগতি সেবা সংস্থা (অসেস) পরিচালকের রাজনৈতিক অতীত ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত। রাজশাহীর কর্ম উন্নয়ন কেন্দ্রর প্রধান এবিএম রাসেলের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
কুষ্টিয়া ও খুলনার সংস্থা
কুষ্টিয়ার খোকসায় চাঁদ মানব উন্নয়ন সংস্থা বেতনভুক্ত কর্মকর্তা ছাড়া স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে। খুলনায় পাঁচটি সংস্থা আবেদন করেছে, এর মধ্যে তিনটিরই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
রাজশাহী ও কুমিল্লায় তালাবদ্ধ অফিস
রাজশাহীর তেরখাদিয়ায় কর্ম উন্নয়ন কেন্দ্রর অফিস তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। কুমিল্লায় জিসা নামের সংস্থার অফিসে নির্বাহী পরিচালক থাকলেও কর্মীরা মাঠে ছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে।
উত্তরাঞ্চলীয় জেলা
কুড়িগ্রামের রাজারহাটে সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয় নেই। তবে জয়মনিরহাট বাজারে বকুলতলা মহিলা সংসদ (বিএমএস) ছোট ভাড়া বাসায় কার্যক্রম চালাচ্ছে।
রংপুরে পাস (পার্টিসিপেটরি অ্যাডভান্সমেন্ট সোশ্যাল সার্ভিস)-র অফিসও বন্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে।
প্রাথমিক তালিকায় থাকা অনেক সংস্থার কার্যক্রম নেই, কিছু শুধু নামসর্বস্ব, আবার কিছু রাজনৈতিক সম্পৃক্ত। ইসির শর্ত অনুযায়ী নিবন্ধনযোগ্য হতে হলে দুই বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন দিতে হয়। তবে বাস্তবে অনেক নতুন ও বিতর্কিত সংস্থাই তালিকায় এসেছে। আগামী ২০ অক্টোবর পর্যন্ত আপত্তি জানানোর সময়সীমা দেওয়া হয়েছে। এরপর শুনানি শেষে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে ইসি।