বাংলাদেশের সাবেক অর্থ, পররাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী এবং দিনাজপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসান মাহমুদ আলী (৮২) ইন্তেকাল করেছেন। বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ১৩ দিন ধরে বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। শুক্রবার সকালে ধানমন্ডির নিজ বাসার সামনে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী ১৯৪৩ সালের ২ জুন দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ভেড়ভেড়ী ইউনিয়নের খামার বিষ্ণুগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা শেষে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সেখানে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন।
১৯৬৮ সালে নিউইয়র্কে পাকিস্তানের ভাইস-কনসাল হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করতে শুরু করেন।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন এবং ওই বছর মে মাসে মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত হন।
মাহমুদ আলী মুজিবনগর সরকারের বিদেশ প্রতিনিধি প্রধান এবং ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান বিচারপতি আবু সায়িদ চৌধুরীর নির্বাহী সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের হয়ে বিভিন্ন মিশনে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন মাহমুদ আলী। বেইজিংয়ে রাষ্ট্রদূতের পদমর্যাদায় উপমিশন প্রধান; ভুটান, অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, জার্মানি ও নেপালে রাষ্ট্রদূত এবং যুক্তরাজ্যে হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত।
ভুটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় রাজ জিগমে সিংগে ওয়াংচুকের সঙ্গে তার সখ্য তৈরি হয়। ঢাকা-থিম্পু সম্পর্ক সে সময় নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।
১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে তিনি ভারতের সাথে তিন বিঘা করিডোর বাস্তবায়ন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। একই বছর মিয়ানমারের শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের আলোচনায় যোগ দেন।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভূমিকার জন্য দুই বছরের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল মাহমুদ আলীকে। সেই হিসেবে ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কূটনৈতিক পেশায় ছিলেন।
২০০১ সালের এপ্রিল মাসে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর মাহমুদ আলী আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী এবং ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণী মামলার নিষ্পত্তি এবং ছিটমহল বিনিময় তিরি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময়ই হয়।
তার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক।