ফরেন সার্ভিস একাডেমির মিলনায়তনে বুধবার (১৫ অক্টোবর) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জরুরি বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, দেশের সব অর্গানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা আপনার (উপদেষ্টার) প্রাথমিক কাজ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আমরা চাই না প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের ভারসাম্য নষ্ট হোক; এ মুহূর্তে আমরা সেটি এফোর্ড (সহ্য) করতে পারব না।”
বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের সামনে সালাহউদ্দিন নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের নিরাপত্তা প্রেক্ষাপট রক্ষার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের দোসররা একসঙ্গে সুযোগ নিতে পারে আমরা এ ধরণের ঝামেলা মাথায় নিতে পারি না; বিভক্তি চাই না।” দলের সমর্থন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের উপদেষ্টার প্রতি ধারাবাহিক সমর্থন আছে; কিন্তু তা শর্তসাপেক্ষ এটি সীমাহীন নয়। আমাদের চাহিদা স্পষ্ট: আপনার অধীনে একটি ঐতিহাসিক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।”
বৈঠকে বিশেষত সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বদলির প্রসঙ্গেও সরাসরি অভিযোগ তোলেন সালাহউদ্দিন। তিনি দাবি করেন, সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা-স্তরের ‘ক্যাবিনেট কমিটি’ করে যে নিয়োগ–বদলির প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, তা কোনো প্রচলিত নিয়ম নয়; ওই প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক বিধি-বিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং সেটি “রাজত্ব” সৃষ্টি করেছে। তিনি উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, তাতে সরকারি পরিষেবা ও মাঠ প্রশাসনে স্বচ্ছতা নষ্ট হচ্ছে এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে যা নির্বাচনপ্রস্তুতিতে বড় ঝুঁকি।
সালাহউদ্দিন বলেন, জাতীয় ঐকমত্যের জটিল বিষয়ের মধ্যে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ সম্পর্কেও পরোক্ষ আশ্বাস দেন বিএনপি স্বাক্ষর করবে, তবে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমতের নোট) স্পষ্টভাবে সংযুক্ত থাকবে। তিনি বলেন, “যেখানে বিভাজন রয়েছে, সেগুলো নথিভুক্ত হবে; যদি সব বিষয়ে সম্মতি থাকত, তাহলে এতটা আলোচনা দরকারই ছিল না।” তিনি উল্লেখ করেন, জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের পরে কমিশন সরকারের কাছে নানা প্রস্তাব ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সুপারিশ করবে এবং প্রয়োজন হলে সেই প্রস্তাবসমূহ গণভোটের মাধ্যমে নিশ্চিত করার পক্ষে বিএনপি দৃঢ় রয়েছে।
বৈঠকে সালাহউদ্দিন পুনরায় রাষ্ট্রের ব্যালান্সড অবস্থা বজায় রাখার গুরুত্বের ওপর জোর দেন বিশেষত প্রতিরক্ষা বাহিনী ও প্রশাসনের মধ্যে। “আপনার (উপদেষ্টার) সঙ্গে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সুসম্পর্ক বজায় থাকুক তবে সেই সম্পর্ক রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করবে এমন কোনও অবস্থার জন্ম দিতে দেব না,” তিনি বলেন।
অন্যদিকে, তিনি নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা নিয়ে স্পষ্ট করেছেন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার লক্ষ্য তাদের। “আমরা চাই এই লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ হবে; এটা জাতির সামনে অতুলনীয়,” তিনি বলেন। পাশাপাশি বললেন, ব্যালট-ভিত্তিক গণভোট ও সংসদীয় নির্বাচনের দিন একইসাথে আয়োজন করলে তা অর্থ- ও জনশক্তি-সাশ্রয়ী হবে এবং জনগণের প্রতি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করবে।
বৈঠকে শুধুমাত্র বিএনপি নয় জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি (রব), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা চলাকালে অগণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা, নির্বাচন-সূচি, সরকারি নিয়োগ–বদলির স্বচ্ছতা ও জাতীয় সনদ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তীব্র তৎপরতা দেখা গেছে।
সভায় অংশ নেওয়া নেতারা সাধারণভাবে একমত ব্যক্ত করেছেন যে দেশে একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও সময়মতো নির্বাচন আয়োজন অপরিহার্য। একইসঙ্গে তারা প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছেন, সকল অঙ্গনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে তাত্ত্বিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।
সালাহউদ্দিনের বিবৃতি ও বৈঠকের রিপোর্ট নির্বাচনী প্রক্রিয়া, প্রতিরক্ষা-প্রশাসন সম্পর্ক এবং সরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং তা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে বলে বিশ্লেষকেরা যুক্তি দেখাচ্ছেন।