জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট আয়োজনের আদেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে জটিল দ্বিধা–দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে জারি হওয়া এই আদেশকে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানালেও দলটির ভেতরে তীব্র ক্ষোভ জন্মেছে। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি প্রকাশ্যে আপত্তি জানালেও দল দুটি ভেতরে ভেতরে সন্তুষ্ট। আদেশটি প্রত্যাখ্যান বা আন্দোলনের পথে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই কোনো দলেরই এমন তথ্য জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সূত্র।
গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতির জারি করা আদেশ জাতির উদ্দেশে ভাষণে তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আদেশ অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন এবং একই দিনে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে যা বিএনপির প্রধান দাবির সঙ্গে মিলে গেছে। এ কারণেই দলটি প্রকাশ্যে নরম অবস্থান নিয়েছে, যদিও আটটি সংস্কার প্রস্তাবে থাকা বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট গণভোটে না রাখার সিদ্ধান্তে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সংলাপগুলোর ধারাবাহিকতায় দলটি নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে ছিল না। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করা নেতারা দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়াই গত ১৭ সেপ্টেম্বর গণভোট মেনে নেন। দলটির ভেতরে এই আচরণকে ‘কৌশলগত ভুল’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, “আদেশ প্রত্যাখ্যান করলে বিএনপিকে ‘সংস্কারবিরোধী’ বানিয়ে নির্বাচনে ফায়দা তুলত জামায়াত। আবার আদেশ মানলেও ক্ষোভ আছে তবু নির্বাচনী স্বার্থে মানতে হয়েছে।”
জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে গণভোট দাবি করলেও আদেশের মূল কাঠামো বিশেষ করে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ–সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো গণভোটে যাওয়ায় দলটি সন্তুষ্ট। এক জ্যেষ্ঠ জামায়াত নেতা বলেন, “গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো গণভোটে যাচ্ছে এটাই আমাদের বড় বিজয়।” তবে প্রকাশ্যে দলটি অভিযোগ তুলছে, সরকার বিএনপিকে খুশি করতে সনদের কিছু অংশ নরম করেছে।
এনসিপি রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে আদেশ জারির কড়াকড়ি বিরোধিতা করলেও ভেতরে ভেতরে সন্তুষ্ট। তাদের প্রধান দাবি ছিল আগামী সংসদের এমপিদের নিয়ে কন্সটিটুয়েন্ট ক্ষমতাসম্পন্ন সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন; আদেশে এই বিধান অন্তর্ভুক্ত থাকায় দলটি ‘বড় জয়’ পেয়েছে বলে মনে করছে। এনসিপি নেতাদের ভাষ্য, “রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর নিয়ে রাজনৈতিক অবস্থান জানাতে হয়, কিন্তু সংস্কার পরিষদ পাওয়া আমাদের কৌশলগত সাফল্য।”
অন্যদিকে বিএনপির ক্ষোভের মূল জায়গা তারা নোট অব ডিসেন্ট থাকা আট সংস্কার প্রস্তাব গণভোটে না যাওয়াকে অগণতান্ত্রিক বলছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, “গণভোটের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন বা সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে এটি সংসদের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।”
একইসঙ্গে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে আশঙ্কা আছে আদেশ প্রত্যাখ্যান করলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। এ কারণে তারা কৌশলগতভাবে আদেশকে স্বাগত জানিয়েছে এবং নির্বাচনের পথ বাধাহীন রাখতে চায়।
সব মিলিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য বক্তব্য ও অন্তর্নিহিত অবস্থানের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়েছে। জুলাই সনদের পক্ষের দলগুলোর কৌশলগত রাজনীতি এখন এক কঠিন ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে—সমর্থনের মুখোশের নিচে জমে আছে অসন্তোষ, আর প্রকাশ্য ক্ষোভের আড়ালে লুকিয়ে আছে নীরব সন্তুষ্টি।