বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-কে উদ্দেশ্য করে পাঠানো এক পত্রে ভোট-সংক্রান্ত কার্যক্রমে পক্ষপাত ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে। দলের পক্ষ থেকে ১ নভেম্বর ইউএনডিপির বাংলাদেশ রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ স্টেফান লিলার বরাবর পাঠানো ১৮ পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ব্যালট প্রজেক্ট (২০২৫–২৭)’ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জাতিসংঘের নিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
চিঠিতে আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং স্বাধীনতা থেকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়। এতে দাবি করা হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্বাধীন রাজনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, এবং “গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন” হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা ও গ্রেপ্তারের অভিযোগ
দলটির অভিযোগ, ১২ মে ২০২৫ তারিখে অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার করে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে এবং নির্বাচন কমিশন দলের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। এতে বিপুলসংখ্যক সমর্থকের ভোটাধিকার বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৪ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; যার মধ্যে শুধু ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এ আটক হয়েছেন প্রায় ১১ হাজার। গ্রেপ্তারদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, শিক্ষক, সাংবাদিক, বিচারপতি ও আমলাও আছেন বলে উল্লেখ করা হয়। মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে দলটি অভিযোগ করে, অনেকের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও চিকিৎসা বঞ্চনার তথ্য রয়েছে।
আইসিটি ও অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা
চিঠিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) পুনর্গঠনকে “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত” বলে দাবি করা হয়। দলটির ভাষ্য অনুযায়ী, নতুন চিফ প্রসিকিউটর অতীতে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ভিন্ন পক্ষের আইনজীবী হিসেবে যুক্ত ছিলেন, যা ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে দলটি “অসাংবিধানিক” বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’-র অজুহাতে ক্ষমতা নেওয়া, সংসদ বাতিল করা এবং অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন পরিবর্তনের অভিযোগ আনা হয়। নতুন নির্বাচনী আইনের কয়েকটি ধারা—বিশেষ করে জোটের দলগুলোকে নিজস্ব প্রতীকে ভোটে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা, পলাতক আসামিদের অযোগ্য ঘোষণা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির বিধান—দলটির দাবি অনুযায়ী, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে উৎসাহিত করতে পারে।
ব্যালট প্রজেক্ট বিষয়ে আপত্তি
১২০ মিলিয়ন ডলারের ‘ব্যালট প্রজেক্ট’-কে চিঠিতে সবচেয়ে বিতর্কিত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আওয়ামী লীগের মতে, দলটি নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় ইউএনডিপির এই প্রকল্প রাজনৈতিক ভারসাম্য ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং একদলীয় নির্বাচনের বৈধতা বাড়িয়ে দেবে। চিঠিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা ও আইসিসিপিআর-এর ধারা উদ্ধৃত করে বলা হয়, রাজনৈতিক মত প্রকাশের কারণে গ্রেপ্তার আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী।
চিঠিতে পাঁচটি দাবি জানানো হয়—
১. ‘ব্যালট প্রজেক্ট’ স্থগিত করা।
২. রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
৩. জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সংলাপ।
৪. মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ মিশন গঠন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন।
৫. সব অধ্যাদেশ সংসদে অনুমোদনের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া।
চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। ইউএনডিপি এ বিষয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই চিঠি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক আলোচনাকে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে আরও গুরুত্ব এনে দেবে।