প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় চাপানো প্রথম মামলার রায়ে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ মৃত্যুদণ্ড ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ফুঁসে উঠেছে জনতা। নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিতর্কিত ট্রাইব্যুনালের এই রায়কে “ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচারের নামে প্রহসন” আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ ঘোষিত সর্বাত্মক শাটডাউন কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছে সাধারণ মানুষ। রোববার মধ্যরাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত রাজধানীসহ অন্তত ৩০টির বেশি স্পটে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ, সড়ক অবরোধ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। দল ও মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
গ্রামীণ ব্যাংকের একাধিক স্থাপনায় আগুন
ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে লক্ষ করে বেশ কিছু জেলার জনতা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বগুড়ার ধুনটে গ্রামীণ ব্যাংকের গোসাইবাড়ী শাখা কার্যালয়ে ভোরে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয় তারা। পুড়ে যায় বিদ্যুৎ সংযোগ, ব্যানার ও আসবাবপত্র। কিশোরগঞ্জ শহরের স্টেশন রোডে যশোদল শাখায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল বিক্ষুব্ধ জনতা।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গ্রামীণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক–২ এ ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সাইনবোর্ডে আগুন লাগানো হয়। পটুয়াখালীর ডিবুয়াপুর শাখায় মশা মারার স্প্রে ব্যবহার করে ব্যাংক কার্যালয়ে আগুন ধরানো হয়েছে।
ঢাকা: নিউ মার্কেট, ধানমন্ডি, শাহবাগে বিস্ফোরণ
রাজধানীতে সোমবার রাত ১০টার পর নিউ মার্কেট, ধানমন্ডি ও শাহবাগ এলাকায় একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। নিউ মার্কেটে চন্দ্রিমা গেটের পাশে টানা বিস্ফোরণ হলেও পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ককটেল বিস্ফোরণের পর পুলিশ ধাওয়া দিলে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা পালিয়ে যায়।
সকালে শাহবাগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন ছবির হাটে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দ্রুত সরে পড়ে দুর্বৃত্তরা।
সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ: বাসে অগ্নিসংযোগ
সাভারের বিরুলিয়া বেড়িবাঁধ এলাকায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে পার্কিং করা একটি বাসে আগুন দেয়া হয়। আশুলিয়ার বেরন এলাকায় ভোরে মিনিবাসে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, পুড়ে যায় অধিকাংশ আসন।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মধ্যরাতে জেলা কর কার্যালয়ের সামনে দাঁড়ানো বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় স্থানীয় জনতা।
সিলেট: এক গ্যারেজে এক ডজন গাড়ি পুড়ল
সিলেট নগরীর আখালিয়ায় একটি গ্যারেজে একসাথে ১২টি যানবাহন পুড়েছে। পুলিশ বলছে, নাশকতার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে এই অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয়েছে কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন এটা বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভের প্রকাশ।
ককটেল হামলায় পুলিশ সদস্য আহত
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে ককটেল ছুড়ে মারে বিক্ষুব্ধ জনতা। এতে নারী কনস্টেবল আইরিন নাহারসহ তিন কনস্টেবল আহত হন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। থানায় ও উপজেলা পরিষদে মোট তিনটি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে।
গত ৮ দিনে মোট ৫৭ গাড়ি পুড়েছে
দেশব্যাপী জনগণের প্রতিরোধের অষ্টম দিনে আগুনে নতুন করে ১৮টি যান অগ্নিকান্ডের শিকার হয়েছে। এই নিয়ে মোট পুড়ল ৫৭টি যানবাহন। মানিকগঞ্জে স্কুলবাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দগ্ধ চালক পারভেজ খানের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল তিন—দুজন আগুনে, একজন পানিতে ডুবে।
সড়ক–রেল অবরোধে ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ
পাবনার ঈশ্বরদীতে ট্রাকভর্তি বালু ফেলে ঢাকা–কুষ্টিয়া মহাসড়ক অবরোধ করে জনতা। একই সড়কে সরইকান্দিতে গাছ কেটে আগুন জ্বালিয়ে বাধা সৃষ্টি করা হয়।
কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে গাছের গুঁড়ি, টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ভোরে রেললাইনে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করা হয়।
স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থনে সফল শাটডাউন
যদিও আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, মাঠের বাস্তবতায় শাটডাউনের সাফল্যের মূল ভূমিকা রাখছে সাধারণ মানুষ। তারা বলছে—“শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবৈধ রায় মেনে নেওয়া যায় না”।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউনূস গং পরিচালিত বিতর্কিত আদালতের রায় সাধারণ জনগণ একধরনের রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। এজন্য মানুষ ঘর থেকে বের না হওয়া, সড়কে অবরোধ, বিক্ষুব্ধ অবস্থান ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় অনেক এলাকায় অগ্নিসংযোগ ঘটছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হলেও জনমানুষের অংশগ্রহণ ও প্রতিরোধের কারণে শাটডাউন কার্যত পরিণত হয়েছে জাতীয় প্রতিবাদ–দিবসে।