আওয়ামী লীগের আহ্বানে ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে নীরবতা ও জনশূন্যতা। বুধবার সড়কে যানবাহনের চাপ কম, অফিস আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি ছিল সীমিত, আর সর্বত্র সতর্ক অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে থাকা বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ছিল বলে জানিয়েছে প্রশাসন। মঙ্গলবার ও বুধবার দুই দিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি স্থানে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, যা জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার ময়মনসিংহে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুনে চালক নিহত হন। গাজীপুর, আশুলিয়া, ফেনী, এমনকি রাজধানীর কাকরাইল, শাহবাগ, তেজগাঁও ও টিএসসির মতো এলাকায়ও একই ধরনের নাশকতা দেখা গেছে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকাংশ ঘটনাই পরিকল্পিত নাশকতা হতে পারে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তথ্য অনুযায়ী, বিগত তিন দিনে রাজধানী ও আশপাশের এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৪৪ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, এসব ঘটনায় কারা জড়িত তা চিহ্নিত করতে তদন্ত অব্যাহত আছে।
ঢাকায় নেমে এসেছে স্থবিরতা
মঙ্গলবার রাত থেকেই রাজধানীর সড়কগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কমে যায়। বুধবার সকালে শাহবাগ, মিরপুর, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, কারওয়ান বাজার ও হাতিরঝিল ঘুরে দেখা গেছে—সড়কে গণপরিবহন চললেও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। অনেক অফিস সময়সূচি পরিবর্তন করেছে, বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মীদের ঘরে বসে কাজের নির্দেশ দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশির কারণে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে যানবাহনের গতি ছিল ধীর। তবুও মোটরসাইকেল, রিকশা ও সিএনজি-চালিত অটোরিকশা চলাচল ছিল কিঞ্চিৎ তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় অতি নগণ্য। ঢাকার বাইরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ফেনীসহ কয়েকটি জেলায়ও একই চিত্র দেখা গেছে।
বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের যৌথ টহল ছিল রাজধানীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সাংবাদিকদের বলেন, “রাজধানীর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোথাও বিশৃঙ্খলা ঘটতে দেওয়া হবে না।”
লকডাউন কার্যত সফল
১৩ নভেম্বরের লকডাউন কর্মসূচি সফলভাবে পালিত হওয়ার পথে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়কে ঘিরে জনগণের শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
দলটির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের অবস্থান জানানো। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘরে থেকে এই কর্মসূচি সমর্থন করছে। এতে প্রমাণিত, আওয়ামী লীগ এখনও জনগণের গভীরে প্রোথিত।”
লকডাউন কেন্দ্র করে বুধবার সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল, নিউমার্কেট, ফার্মগেট ও গুলশানে দোকানপাট অনেকটা ফাঁকা ছিল। সরকারও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর অবস্থানে ছিল।
নাগরিকদের উদ্বেগ ও প্রশাসনের সতর্কতা
নাশকতার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেক স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বৃহস্পতিবার অনলাইন ক্লাস পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে। বেশ কিছু পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
মোহাম্মদপুরের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, “শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আমরা আপাতত অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি। আশা করছি পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, যারা নাশকতার সঙ্গে জড়িত তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে স্থাপন করা হয় চেকপোস্ট, চালানো হয় তল্লাশি অভিযান। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম জানান, “ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায় বিজিবির মোট ১৪ প্লাটুন সদস্য মোতায়েন আছে এবং তারা পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক অগ্নিসংযোগ ও বিস্ফোরণ জনমনে উদ্বেগ বাড়িয়েছে এবং দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতক্ষণ নিয়ন্ত্রণে থাকে সেটা নিয়ে শঙ্কা আছে।
১৩ নভেম্বরের লকডাউন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকার চিত্রকে স্থবির করে দিলেও আওয়ামী লীগ তাদের দাবি অনুযায়ী ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ’ দেখাতে সক্ষম হয়েছে এখন পর্যন্ত, তবে দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।