বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে আজকাল এক নব নবতর তন্ত্রের আবির্ভাব ঘটিয়াছে। গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র—ইহাদের সকলকে ছাড়াইয়া আজ রাজত্ব করিতেছে এক মহাতন্ত্র, যাহার নাম লুটতন্ত্র। ইহা গণতন্ত্রের আধুনিক সংস্করণ—একটি উদার, সর্বগ্রাসী, সর্বজনীন তন্ত্র, যাহা সকল শ্রেণি, সকল পেশা, সকল ধর্ম, সকল বর্ণের উপর সমানভাবে প্রয়োগযোগ্য।
গণভবন হইতে শুরু করিয়া সংসদভবন, দোসরের বাড়ি, দোকানপাট, বাজার, সরকারি জমি, সিলেটের পাথর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছ—কিছুই বাদ যায় নাই। লুটের তালিকায় আছে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ধর্ম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি—যাহা কিছু হৃদয়ের, তাহাই আজ হাটে-মাঠে লুন্ঠনযোগ্য।
লুটেরারা মুখে সুশীলতার মুখোশ পরিধান করিয়া, কণ্ঠে মধুর বাক্য ধারণ করিয়া, রাষ্ট্রের প্রতিটি কোণায় কোণায় লুটতরাজ চালাইতেছে। জনগণ বিক্রয় হইতেছে, অথচ তাহারা হাস্যোজ্জ্বল মুখে, আনন্দচিত্তে, বিগলিত মনে বলিতেছে—“এই তো নয়া বন্দোবস্ত!, ইহাই স্বপ্নের দেশ”।
হিন্দুদের বাড়ি লুট করা সহজ, আদিবাসীদের জমি লুট করা সহজতর, গরিবের অন্ন লুট করা তো নিত্যদিনের খেলা। মধ্যবিত্তের পকেট হইতেছে লুটের মহোৎসবের ক্রীড়াঙ্গণ। অথচ, যাহারা লুট করিতেছে তাহারা আনন্দিত, যাহাদের লুট হইতেছে তাহারাও আপ্লুত। ইহাই লুটতন্ত্রের মহিমা।
বাংলাদেশ নামক আনন্দলোকে, লুন্ঠনের মঙ্গলালোকে যজ্ঞ চলিতেছে। স্বৈরাচারের পতনে উল্লসিত জনতা আজ সামাজিক নৈরাজ্যকে বুকে টানিয়া লইয়াছে। আইন, ন্যায়, বিচার—ইহারা এখন কেবলই নাট্যশালার সংলাপ।
আলেকজান্ডার যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতেন, তবে সেলুকাসকে কুমড়াচেঙ্গি দিয়া বলিতেন—“ইহাই সেই দেশ, যাহা অনেকদিন ধরিয়া খুঁজিয়াছি। আসো, অভিযান সমাপ্ত করিয়া আনন্দ করো।”
লুটতন্ত্রে আজ সকলেই সমান—কেহ লুট করিতেছে, কেহ লুট হইতেছে, কেহ লুটের প্রশংসায় তালি বাজাইতেছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভে আজ লুটের জয়ধ্বনি। ইহাই আমাদের নতুন জাতীয় সঙ্গীত—“লুটের ছন্দে জ্বলছে বাতি, লুটের তালে নাচছে জাতি।”
লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল - লুন্ঠিত সময়কে যে তাহার কলঙ্কিত কালিতে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে