যখন জাতি গর্বে বুক ফুলায়, তখন আমাদের ক্রিকেট দল নিঃশব্দে সেই বুকে ছুরি চালায়। এশিয়া কাপের সুপার ফোরে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে কোন মতে জিতিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রায় জেতা ম্যাচে হারিয়া, তাহারা প্রমাণ করিয়াছে—জয় নয়, অংশগ্রহনই আসল। এই চেষ্টার মহিমা বুঝিতে না পারিয়া জনসাধারণ প্লেয়ারদের গালিগালাজে ব্যস্ত, অথচ অন্তরালে ঘটিতেছে এক মহাজাগতিক রূপান্তর।
আমাদের ওপেনার পারভেজ ইমন, যিনি ফিল্ডিংকালে বলের পেছনে এমনভাবে দৌড়ান, যেন বলটি তাহার প্রেমিকা আর তিনি বলের পেছনে কুঁদিয়া কুঁদিয়া প্রেম নিবেদন করিতেছেন। ব্যাটিংকালে তিনি ড. ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্বে বিশ্বাসী—তিন বল, তিন জিরো, তিনবার আউট। তিনি বিশ্বায়নের অগ্রসেনানী, জিরোকে সার্বজনীন করিবার ব্রত লইয়া মাঠে নামেন। প্রধান উপদেষ্টা ইতিমধ্যে তাঁহার এই নিরলস জিরো-সাধনাকে জাতীয় পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করিয়াছেন।
অন্যদিকে আমাদের ফিনিশার জাকের আলি, যিনি ব্যাট হাতে সিক্স মারিবার পরিবর্তে জিমে সিক্স প্যাক বানাইতে ব্যস্ত। তিনি জানেন, সিক্স মারিলে ম্যাচ জেতা যায়, কিন্তু সিক্স প্যাক থাকিলে ইনস্টাগ্রামে ফলোয়ার বাড়ে। স্বাস্থ্যই সম্পদ—এই মহান বাণীকে হৃদয়ে ধারণ করিয়া তিনি প্রতিপক্ষের বোলারদের বলকে সম্মান করিয়া ডট বলের মালা গাঁথেন।
তৌহিদ হৃদয়, যাঁহার হৃদয়ে প্রেমের ফল্গুধারা বইতেছে। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রতিপক্ষকে আঘাত নয়, স্নেহ দান করাই ক্রীড়ার প্রকৃত সৌন্দর্য। তাই তিনি ব্যাট হাতে বলকে চুম্বন করিয়া এক-দুই রান লইয়া শান্তির বার্তা বহন করেন। জাতিসংঘ ইতিমধ্যে তাঁহার নাম শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করিয়াছে।
এতদ্বারা প্রমাণিত হয়, আমাদের ক্রিকেটারগণ কেবল খেলোয়াড় নন, তাঁহারা কূটনীতিক, দার্শনিক, প্রেমিক এবং সমাজ সংস্কারক। ইলিশ মাছ বিলাইয়া, ম্যাচে ক্যাচ ফেলিয়া ইন্ডিয়াকে ম্যাচ উপহার দিয়া তাঁহারা প্রতিবেশী সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা দিতেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁহাদের এই উদারতা লইয়া একটি নতুন নীতিমালা তৈরির চিন্তাভাবনা করিতেছে—“ক্যাচ ফেলিয়া কূটনীতি গড়ো”।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যেন এক খণ্ড বাংলাদেশ—যেইখানে প্রত্যাশা আছে, প্রস্তুতি নাই; প্রতিশ্রুতি আছে, পারফরম্যান্স নাই। যেইখানে ব্যর্থতা একটি শিল্প আর হার একটি উৎসব। তাঁহারা আমাদের শিখাইতেছেন, জয় নয়, ব্যর্থতার মধ্যেও সৌন্দর্য আছে। তাঁহারা আমাদের জাতীয় চরিত্রের প্রতিচ্ছবি—যেখানে ‘হইবে না’ বলিয়া আমরা ‘চেষ্টা করিয়াছি’ বলিয়া আত্মতৃপ্ত হই।
তাই আসুন, আর গালি না দিয়া, আমাদের এই মহান ক্রিকেট সেনানীদের জন্য একটি জাতীয় দিবস ঘোষণা করি—“ব্যর্থতা দিবস”, যেই দিন তাঁহাদের জিরো, ডট, ক্যাচ ফেলা ও প্রেমময় রানগুলিকে স্মরণ করিয়া আমরা জাতিগত আত্মসমালোচনার উৎসবে মেতে উঠিব।
লেখক: এক ক্লান্ত পেন্সিল, যে ব্যর্থতার আঘাতে বিদীর্ণ হতে হতে মৃত সময়কে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে