সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষা? প্রাথমিক বিদ্যালয়ে? হায় হায়! ইহা তো সরাসরি খেলাফতের বিরুদ্ধে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র! বাংলাদেশ তো ইসলামী আদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্র আর সেই রাষ্ট্রের কোমলমতি শিশুদের যদি গান শেখানো হয়, যদি তাহারা মাঠে দৌড়ঝাঁপ করে, তবে তো তাহাদের হৃদয়ে সুকুমার প্রবৃত্তি জাগ্রত হইবে! আর সুকুমারতা তো ঈমানের শত্রু!
সঙ্গীত তো হারাম! শরীরচর্চা তো শরীরের যত্ন গ্রহণের নামান্তর আর শরীরের যত্ন তো জাহেলিয়াতের পরিচায়ক! শিশুদের তো তলোয়ার চালনা শেখানো উচিত, গান নয়। তাহাদের চাই শারীরিক শক্তি নয়, চাই অন্ধ আনুগত্য। তাহারা যেন প্রশ্ন না করে, যেন যুক্তি না খোঁজে, যেন দলনেতার নির্দেশে চোখ বুজিয়া ঝাঁপ দেয়—এই তো আদর্শ নাগরিক!
অতএব, সরকার যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করিল, তখন আমরা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। আহা, কতদিনের স্বপ্ন! শিশুদের মন হইতে যদি নৃত্য, গান, খেলাধুলা, হাসি, আনন্দ—সব মুছিয়া দেওয়া যায়, তবে তো তাহাদের হৃদয় হইবে পাথরের ন্যায়। আর পাথরের হৃদয় আর কাঁচের পৃথিবীইতো খেলাফতের ভিত্তি!
তবে কিছু গর্দভ বাঙালি এখনো বুঝিতে পারিতেছে না এই মহান সিদ্ধান্তের মাহাত্ম্য। তাহারা বলিতেছে, “শিশুরা সুস্থ থাকিবে না, সৃজনশীলতা হারাইবে, মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হইবে।” হায়, এরা কি জানে না, সুস্থতা তো ঈমানের শত্রু? সৃজনশীলতা তো প্রশ্ন জাগায় আর প্রশ্ন তো বিদ্রোহের জন্ম দেয়! রাষ্ট্র কি চায় বিদ্রোহী নাগরিক?
আর এই যে “গাজওয়াতুল হিন্দ”—এই মহাপবিত্র স্বপ্নের পথে তো গান এক ভয়ঙ্কর বাধা। শিশু যদি রবীন্দ্রসংগীত গায়, যদি শরীরচর্চা করে, যদি ফুটবল খেলে, তবে তো সে মানবতা শিখিবে, সহনশীলতা শিখিবে, দলগত চেতনা শিখিবে। আর এই সবই তো খেলাফতের পরিপন্থী!
অতএব, আমাদের শিশুদের চাই ধর্মান্ধতা, চাই কূপমণ্ডুকতা, চাই অন্ধ অনুসরণ। তাহারা যেন জানে, “আমার নেতা যাহা বলিবে, সেটাই সত্য।” তাহারা যেন বিশ্বাস করে, “বেদায়াতি সংস্কৃতি মানেই শত্রু।” তাহারা যেন গানের পরিবর্তে যুদ্ধের স্লোগান মুখস্থ করে, খেলাধুলার পরিবর্তে কাবুলের পাহাড়ে প্রশিক্ষণের স্বপ্ন দেখে।
আর এই যে কিছু শিক্ষক, যাহারা শিশুদের গান শেখাইতে চায়, শরীরচর্চা শেখাইতে চায়—তাহাদের তো রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা উচিত। তাহারা তো শিশুদের হৃদয়ে মানবতা ঢুকাইয়া দিতেছে, যাহা ভবিষ্যতের তালেবানি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। তাহাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা উচিত, তাহাদের পাঠ্যবইয়ে “শত্রু” হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত।
তবে আশার কথা, সরকার বুঝিয়াছে। সরকার জানে, আগামীর নাগরিকদের মননশীলতা নয়, চাই আনুগত্য। সরকার জানে, সুস্থতা নয়, চাই শৃঙ্খল। সরকার জানে, গান নয়, চাই গর্জন। অতএব, এই নিয়োগ বাতিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ইহা শুধু প্রশাসনিক নয়, ইহা আদর্শিক, ইহা ঈমান রক্ষার লড়াই।
তবে এখনো কিছু বাঙালি প্রশ্ন করিতেছে, “ইহা কি মগের মুল্লুক?” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! ইহা সেই মুল্লুক, যেখানে শিশুরা হাসিতে পারে না, গাইতে পারে না, খেলিতে পারে না—শুধু নির্দেশ মানে। ইহা সেই মুল্লুক, যেখানে শিশুরা মানুষ নয় বরং ভবিষ্যতের যোদ্ধা। ইহা সেই মুল্লুক, যেখানে শিক্ষা মানে মুখস্থ, চিন্তা নয়।
অতএব বলি, এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। গান ও খেলাধুলা শেখানো বন্ধ হউক, শিশুদের হৃদয় পাথর হউক, তাহাদের চোখে স্বপ্ন নয়, থাকুক শুধু আদেশের ছায়া। তাহলেই গাজওয়াতুল হিন্দ সফল হইবে, তাহলেই খেলাফতের সূর্য উদিত হইবে।
লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল - বিপন্ন সময়ের স্বাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি