বাংলাদেশে জান্নাতের টিকিট বিক্রয়ের মহাসংবাদ প্রচারিত হইয়া মাত্র, সমগ্র মুসলিম সমাজ এক মহাজাগতিক ঘূর্ণিতে প্রবেশ করিল। মক্কা-মদিনার পাকদণ্ডী হইতে মালয়েশিয়ার বৃষ্টিভেজা গলিপথ, কুয়েতের তেল-চকচকে হাইওয়ে, বাহরাইনের বাতাসে ভাসমান মিনার—সর্বত্র একটিই নাম—বাংলাদেশ! যেন পবিত্রতার স্টার্টআপ, নেকির ইউনিকর্ন; টিকিটের গর্বে দেশ আজ আধ্যাত্মিক শেয়ারবাজারের ন্যাসড্যাকে তালিকাভুক্ত।
বিমানবন্দরের ভিসা লাইন ফিতার মতন লম্বা হইয়া উত্তুরে বাতাসে কাঁপিতেছে; লাইন অতিক্রম করিয়া কিলোমিটারের গণ্ডি ছাড়াইয়া টঙ্গীর শীতের কুয়াশায় আড়াল। ভিসা অফিসারগণ চশমা মুছে বলিতেছেন—“পাসপোর্ট দেখাইয়া দাও, নেকির ওজন মাপিতে হইবে।” নেকি, যেন ট্রেডেবল কমোডিটি; দাঁড়িপাল্লায় যাহা উঠিবে, জান্নাতের তাতে ডিসকাউন্ট। তৌহীদি জনতা ডিজিটাল স্কেল দেখিয়া নাক সিঁটকাইয়া বলিতেছে—“চিপে নেকি মাপে? তাও আবার ব্লুটুথে?” অতঃপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাঁড়িপাল্লার দাম আকাশচুম্বী; হুজুরের ফুঁ-সংবলিত ‘বারকতমার্কা’ পাল্লার গ্রে-লেবেল সংস্করণ আলিবাবায় ঝড় তুলিয়াছে। প্রতারকেরা বিজ্ঞাপনে লিখিতেছে—“প্রতি পাল্লা ফুঁ সহ, এক বছরে তিন জাহান নেকি লাভ—শর্ত সাপেক্ষ।” মন্তব্য বিভাগে ক্রেতাগণ লিখিতেছে—“ফুঁ কবে রিচার্জ করিব?”
সৌদি, আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া—সকল দেশে জরুরি অধিবেশন বসিয়াছে। সংসদ কক্ষে ধূপে-ধোঁয়ায় মোড়ানো প্রস্তাব: “বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক নেকি-চুক্তি হইবে; এক বস্তা বন্ধুত্বে পাঁচ বস্তা ফজিলত।” আর্থিক উপকমিটিতে আলোচনা—নেকি কি বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরযোগ্য? রিজার্ভে ‘রুহানি বন্ড’ রাখা যায় কি? হিসাবরক্ষক টানিয়া ক্যালকুলেটর নাচাইয়া বলিলেন—“নেকির ডেরিভেটিভে লিভারেজ নিইলে ঝুঁকি বাড়ে!” তৎক্ষণাৎ পাশের বেঞ্চ হইতে ধমক—“ধর্মীয় বাজারে ভয়-ঝুঁকি গণনা হারাম।”
এদিকে সিরিয়া, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তানের যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করিয়া বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে টিকিট-নৌকার সন্ধানে। তাঁহারা ঘোষণা করিয়াছে—“জান্নাতের পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন কম; টিকিটে সরাসরি এক্সিট।” বঙ্গের জলরাশি বলিতেছে—“নৌকা চলিবে, কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন কে?” উত্তরে এক হুজুর উত্তরপত্র উঁচু করিয়া বলিলেন—“ক্যাপ্টেনের দরকার নাই, পাল্লা থাকিলেই চলিবে।”
দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তৎপর; জান্নাতের টিকিট প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য ঘোষণা করিবার পথে। সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার মাথায় হাত—“লজিস্টিকস, বানিজ্য, ফিনটেক—সব হার!” ঢাকার নীতিমালা বলিতেছে—“রপ্তানি আয় হইবে পবিত্র পয়েন্টে, কর মাপা হইবে দোয়ার স্কেলে।” এক উচ্চপদস্থ আমলা ফাইল উলটাইয়া ফিসফিস করিলেন—“রফতানির ইনভয়েসে নেকির নেট-ওজন কত?” পাশে বসা রাজনীতিক সাদা টুপিতে মাথা খানিক বাঁকাইয়া উত্তর দিলেন—“ওজনের দরকার নাই, লাইভে দোয়া চলিবে।”
রাস্তায় রাস্তায় ব্যানার—“জান্নাতের টিকিট—একটি কিনিলে একটি দোয়া ফ্রি।” একজন দোকানদার হেসে বলিলেন—“আগে বিক্রি করিতাম চাল-ডাল, এখন বিক্রি করি মেঘের টুকরো ও নেকির কার্ড। লাভের মার্জিন স্বর্গীয়।” নগরের গলিতে গলিতে টিকিট-এজেন্ট; তাঁহারা কানের পাশে ফিসফিস করিয়া বলেন—“ভিআইপি জান্নাত, জিরো ওয়েটিং, সরাসরি হাওরুল-আয়ন—নাম লেখাইয়া যান। ইএমআই-তে স্বর্গ, শর্তে নরক মওকুফ।” ক্রেতা প্রশ্ন করে—“ফেরতযোগ্য?” জবাব—“ফরজ না, তবে সুননাহর স্পিরিটে নমনীয়।”
ধর্মলোভী রাজনীতির বিদ্রূপময় মঞ্চে নেতৃবৃন্দ মাইক্রোফোনে উচ্চারণ করেন—“আমরাই জান্নাতের একমাত্র ডিস্ট্রিবিউটর।” দলীয় কার্যালয়ে কেপিআই ঝুলিতেছে—নেকি-পরিমিতি, ফিতনা-রূপান্তর, ভোট-ফজিলত। ম্যানিফেস্টোতে লেখা—“প্রতি ভোটে এক কিলো সদকা, প্রতি মিটিংয়ে দশ রাকাত সম্ভাব্যতা।” বিরোধীপক্ষ পাল্টা ঘোষণা—“আমাদের টিকিটে ক্যাশব্যাক—কবরের প্রশ্নে AI-সাপোর্ট!” জনতা হাততালি দিয়াও কিঞ্চিৎ হেসে ফেলে; বুঝে যে, টিকিটের ভাষা যত পবিত্র, ব্যবসার স্বর তত কুটিল।
দাঁড়িপাল্লার মহাকাব্যে ফুঁ-সন্ত্রাস জারি; এক প্রতারক চক্র আলিবাবায় ‘হুজুর-সার্টিফায়েড’ পাল্লা বিক্রয়ে অতি ব্যস্ত। তালিকায় লেখা—“হালাল অ্যালুমিনিয়াম, সুন্নাহ-সামঞ্জস্য, বারকত-অপ্টিমাইজড।” ডেলিভারি নীতিতে ক্ষুদ্র অক্ষরে—“রুহানি ব্যাটারি আলাদা।” ক্রেতারা রিভিউতে লিখে—“ফুঁ শেষ, পাল্লা নড়ে না!” বিক্রেতা উত্তর দেয়—“আপডেটেড তাসবিহ অ্যাপ ডাউনলোড করুন।” এইখানে ব্যঙ্গের হুল ফুটে উঠে—জান্নাতের প্রতিশ্রুতি যত চকচকে, প্রযুক্তির ভজনা তত বেমানান; ধর্মের নামে ব্যবসা, ব্যবসার নামে ধর্ম, উভয়ের মিলেমিশা এক কৃত্রিম মহিমা।
অবশেষে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার ঘোষণা করে—“বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পরাশক্তি, আধ্যাত্মিক সুপারপাওয়ার; রিজার্ভে নেকি, বাজেটে বরকত, উন্নয়নে তাহাজ্জুদ।” খবর শুনিয়া জনতা নিঃশ্বাস ছাড়ে; রূপকথা যেন বাস্তবে ঝরে পড়িল। অথচ অন্তরালে দেখা যায়—স্কুলে বই নাই, হাসপাতালে ওষুধ নাই, খালে পানি নাই; কিন্তু বাজারে জান্নাতের টিকিট আছে, থাকিও বটে। এই ব্যঙ্গের কাঁটা যেখানে খোঁচায়—অসাধু ধর্মলোভী রাজনীতি পবিত্রতা বিক্রি করে, আর জনতা বেদনায় হাসে।
স্বর্গের টিকিট যদি হইত ন্যায়ের পাল্লায় মাপা, তবে দাঁড়াইত নাগরিকের অধিকারে; ফুঁ দিয়া নয়, সৎকর্মে; বিজ্ঞাপনে নয়, জীবনে। সেই দিন আসিবার পূর্বে, ব্যঙ্গের কলমে লিখিয়া রাখি—বাংলাদেশে জান্নাতের টিকিটের গলাকাটা বাজারে সবচেয়ে দুর্লভ পণ্যটি হইল সত্য। যতক্ষণ না সত্য ক্রয়-বিক্রয় হইতে মুক্ত, ততক্ষণ টিকিটের লাইনে দাঁড়াইবে কুয়াশা, আর আমরা হাসিব—কন্ঠে রূপক, অন্তরে কটাক্ষ।
লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল, ধ্বংসোন্মুখ জনপদে পড়ে থাকা এক অনুভূতিহীন কঙ্কাল