গাজায় ধ্বংস হইয়াছে আড়াই লক্ষ দালানকোঠা, নিহত হইয়াছে ষাট হাজারের অধিক প্রাণ, যাহার মধ্যে বিশ হাজারই শিশু। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়াইয়া যদি প্রশ্ন করি—বাঙালিরা যদি গাজায় থাকিত, তবে কী করিত?
তাহারা প্রথমেই করিত রডের হিসাব। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ভাঙা রড খুলিয়া তাহারা ভাঙ্গারি ব্যবসা শুরু করিত। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ তাহাদের কাছে হইত সোনার খনি। তাহারা বলিত, “রডে তো এখন কেজি চারশো, ভাই! আল্লাহর রহমতে ব্যবসা জমজমাট!”
দূর্ভিক্ষে কাতর শিশুদের দিকে চাহিয়া তাহারা বলিত, “এক প্যাকেট বিস্কুট—দুইশো টাকা। না থাকিলে মরো, ভাই! আমরা তো ব্যবসায়ী, দাতব্য সংস্থা নহি।” পিতা-মাতা মরিয়া যাইত, তাহাদের কোলে কাঁদিয়া থাকা শিশুটিকে চুরি করিয়া বিক্রি করিত মানবপাচারকারী। তাহারা বলিত, “এইটা তো orphan, ভাই! আমরা তো ওরে ভালো জায়গায় পাঠাইতেছি।”
হুজুরগণ ফতোয়া দিতেন। যুদ্ধ হউক, দুর্যোগ হউক, ভূমিকম্প হউক—তাহারা বলিতেন, “হাঁটুর উপর কাপড় উঠিবে না। বেগানা পুরুষের সামনে মুখ দেখানো হারাম। গাজায় মরিয়া যাওয়া নারীরা যদি পর্দা না করে, তবে তাহাদের মৃত্যুতে রহম নাই।” তাহারা যুদ্ধের রক্তে নয়, কাপড়ের দৈর্ঘ্যে ঈমানের পরিমাপ করিতেন।
হাসপাতালে ডাক্তার বলিতেন, “রুগির গুলি লাগিয়াছে? সমস্যা নাই। আগে ভর্তি ফি জমা দিন, ফর্ম পূরণ করুন, তারপর চিকিৎসা। না হইলে মরিয়া যাইতে পারেন, আমরা দায়ী নহি।” তাহারা মানবতা নয়, নিয়মের ফাইল খুঁজিতেন।
কোন শিশু গুলি খাইয়া পড়িয়া থাকিলেও বাঙ্গালী শিক্ষক বলিতেন - উহাকে তুলিবোনা, ব্যাটা আমার কাছে কোচিং করিলো না - এমনই পাঠা।
বাঙালি সমাজে মনুষ্যত্বের সংকট এত গভীর, যাহা রক্তের ব্যাগেও প্রবেশ করিয়াছে। স্বেচ্ছায় দানকৃত রক্তের ব্যাগ হইতে রক্ত বাহির করিয়া তাহাতে রংগোলা জল ও স্যালাইন ঢালিয়া বিক্রি করিবার সাহস রাখে এই জাতি। তাহারা বলিত, “ব্যবসা তো ব্যবসা, ভাই! রক্তে তো VAT নাই।”
তাহারা গাজার ধ্বংসে কান্না করিত না, বরং বলিত, “এই ধ্বংসে কতটা লাভ করা যায়?” তাহারা মানবতা নয়, মুনাফা খুঁজে। তাহারা শিশুর কান্না শুনিয়া বলিত, “এইটা তো potential product!”
বাঙালি কবে মানুষ হইবে? কবে তাহারা বুঝিবে, রডের চেয়ে রক্ত মূল্যবান, ফতোয়ার চেয়ে সহানুভূতি জরুরি, নিয়মের চেয়ে মানবতা বড়? কবে তাহারা যুদ্ধের ধ্বংসে ব্যবসা নয়, বেদনা দেখিবে?
গাজায় বাঙালি থাকিলে, হয়তো ধ্বংসের মধ্যেও তাহারা দোকান খুলিত, ফতোয়া দিত, রক্ত বিক্রি করিত। কিন্তু তাহারা মানুষ হইত না। কারণ, মানুষ হইবার জন্য হৃদয় লাগে, আর তাহা বাঙালির সমাজে বিলুপ্তপ্রায়।
শেষ প্রশ্ন—বাঙালি কবে মানুষ হইবে? হয়তো যেদিন তাহারা রক্তে রংগোলা নয়, ভালোবাসা মিশাইবে। হয়তো যেদিন শিশুর কান্না শুনিয়া তাহারা বলিবে, “এইটা তো আমার সন্তানের মতো।” হয়তো... কিন্তু সেই দিন এখনও বহু দূর।
লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল, অভিশপ্ত সময়কে যে কলঙ্কের কালিতে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে