‘যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন
শেষ হ’য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক-কর্কট-তুলা-মীন।’: জীবনানন্দ দাশ।
বাংলাদেশে আসছে ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জুলাই ২০২৪-উত্তর ‘ইনকিলাব সাংস্কৃতিক মঞ্চ’-এর আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদি গত ১২ই ডিসেম্বর শুক্রবার সাপ্তাহিক জুম্মার নামাজ পড়ে, মসজিদ থেকে বের হয়ে বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় রিক্সায় করে কোথাও যাওয়ার সময় মোটর বাইক আরোহী কারো গুলিতে গুরুতর ভাবে আহত হন। এক সপ্তাহের প্রচুর জল্পনা-কল্পনা শেষে গতকাল রাত দশটায় সিঙ্গাপুর থেকে হাদির মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছলে অসংখ্য হাদি সমর্থক দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই পত্রিকা ‘দ্য ডেইলী স্টার’ ও ‘প্রথম আলো’ কার্যালয়ে অগ্নি-সংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করে।একই কাজ করা হয় ‘ছায়ানট’-এ এবং সর্বশেষ খবর পর্যন্ত আজ সন্ধ্যায় ‘কম্যুনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশ (সিপিবি)’-এর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘উদীচী’ কার্যালয়েও আগুন দেওয়া হয়েছে।
গতকাল জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থক দেশের অন্যতম নামী সাংবাদিক ও ‘দ্য নিউ এজ’ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হাদি সমর্থক তরুণেরা দৈহিক ভাবেও অসম্মান করে এবং ‘আওয়ামী লীগ’ সমর্থনের অভিযোগ করে। উল্লেখ্য, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নূরুল কবীর ছিলেন অন্যতম লীগ সরকার বিরোধী সাংবাদিক। গতকাল দেশের বৃহত্তম ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলী স্টার’-এ আগুন দেওয়া হলে নৈশ শিফটের সাংবাদিকরা একটি পর্যায়ে প্রাণ বাঁচাতে ছাদে উঠেও চারপাশে আগুনের হল্কা ও ধোঁয়ায় প্রাণ ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন। জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক ও সক্রিয় সাংবাদিক জাইমা ইসলাম ফেসবুকে ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না। এত ধোঁয়া! তোমরা আমাদের মেরে ফেলছো’ পোস্ট দিতে বাধ্য হন।
জাইমাও কিন্তু জুলাই আন্দোলনের অন্যতম ‘অংশীজন’ ও আন্দোলন নিয়ে নেপাল সহ একাধিক দেশে সেমিনার এবং ওয়েবিনারে সাংবাদিক ও এ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। যাহোক, জাইমা সহ বহু সাংবাদিকই এসময় চেনা মানুষদের ফোন করে বা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে প্রাণে বাঁচার আকুতি জানাতে থাকেন। অবশেষে বিদ্যমান সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সাহায্যে ২৫-৩০ জন সাংবাদিককে মুক্ত করা হয়। এদের মাঝে জুলাই আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের পুরোধা কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি যেমন ‘দৃক’ আলোকচিত্রাগারের প্রতিষ্ঠাতা ও নামী আলোকচিত্রী শহীদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও বর্তমানে কলামিস্ট রাহনুমা আহমেদ, সঙ্গীতশিল্পী সায়ানের ছবি দেখেই অনেকেই স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। যেহেতু এরা প্রত্যেকেই বিগত সরকারের আপ্রাণ বিরোধী ছিলেন ও এই সরকারের নিবেদিত, তাত্ত্বিক সমর্থক। তবে, ছবিতে কাউকেই তেমন ভীত মনে হয়নি। বরঞ্চ মনে হয়েছে বেশ হাসি-খুশি। হয়তো উদ্ধার পাবার স্বস্তিতে বা এই সরকারেরই যেহেতু তারা অংশীজনই বটে, ভীত-সন্তস্ত্র হবার কী বা তাদের আছে?
আপাততঃ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইউ টিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ও প্রদর্শিত খবর অনুযায়ী গোটা ‘দ্য ডেইলী স্টার’ বিল্ডিংয়ের প্রায় পুরোটাই এখন ভাঙ্গা কাঁচ ও খবরের কাগজের ছাইয়ের স্তুপ। সেই পত্রিকার এক সিনিয়র আলোকচিত্রীকে একটি ইউটিউব চ্যানেলে কাঁদতে দেখা গেলো তার বহু পুরনো আলোকচিত্রের সংগ্রহ, ক্যামেরা ও টাকা- সবই পুড়ে যাওয়ায়। বর্তমানে প্রবাসী তবে ‘দ্য ডেইলী স্টার’-এ দীর্ঘ সময় কাজ করা এক প্রাক্তন সাংবাদিক তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে ফোনে জানতে পেরেছেন যে হামলাকারীরা সাংবাদিকদের কেবিনেট ভেঙ্গে কলম, চায়ের কাপ থেকে শুরু করে ক্যাফেটেরিয়ার আইসক্রিম পর্যন্ত লুট করেছে। সত্যি বলতে, ‘দ্য ডেইলী স্টার’-এর ৩৪ বছরের জীবনে এবং ‘প্রথম আলো’ প্রকাশিত হবার পর থেকে গত ২৬ বছরের জীবনে আজই এই দুই পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ কর্তৃপক্ষ পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি এবং সেই সাথে অনলাইন প্রকাশনাও অচল হয়ে পড়েছে।

‘প্রথম আলো’-র অবশ্য ‘দ্য ডেইলী স্টার’-এর তুলনায় কিছুটা কম ক্ষতি হয়েছে। তাদের মূল ভবন অক্ষত তবে ছোট ভবন যেখানে ‘প্রথমা প্রকাশনী,’ ‘বন্ধুসভা’র কার্যালয় ও ক্যাফেটেরিয়া ছিল, সেই ভবনটিই আগুনে পুড়ে গেছে। অবশ্য ‘প্রথমা প্রকাশনী’ থেকে গত কিছু বছরেই ‘প্রথম আলো’ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে। সেই বইগুলোই পুড়ে গেলো কিনা ভেবে দেশের যে কোন সচেতন, সাধারণ নাগরিকেরই মর্মাহত ও বিপন্ন বোধ করার কথা। ইতোমধ্যে আমরা ইউটিউবে বিধ্বস্ত ভবনের সামনে ‘প্রথম আলো’ সম্পাদক মতিউর রহমান, নামী লেখক ও সাংবাদিক আনিসুল হক, কবি ও ‘প্রথম আলো’-র নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফকে দেখেছি। সাজ্জাদ শরীফ তার বক্তব্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহল যারা বাংলাদেশের নির্বাচন চায় না এবং একইসাথে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে চায়, তারা এই হামলা করেছে বলে তার অনুমান জানান।
হামলাকারীরা গত রাতে সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’-এ হামলা চালায়। ধানমন্ডির শঙ্করে অবস্থিত এই ছ’তলা প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করা হয় এবং নথিপত্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। দুই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী লাইসা আহমেদ লিসা ওসমান হাদির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেন যে হাদির মৃত্যুর সাথে ‘ছায়ানট’ ভাঙার কোন বোধগম্য কারণ তিনি বা তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো এই ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘ধার্মিক’ জনতা বাদ্যযন্ত্র শুধু ভেঙেই ক্ষান্ত হয়নি, ইউটিউবে তাদের কাঁধে বড় বড় স্কেল চেঞ্জার হার্মোনিয়াম সহ দামি কিছু বাদ্যযন্ত্রও তাদের লুট করতে দেখা গেলো। যেমনটি গত বছর ‘গাজা’ গণহত্যার প্রতিবাদে ইহুদি মালিকানা সন্দেহে বাংলাদেশী মালিকানারই ‘বাটা’ দোকান লুট করতে দেখা গেছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে অগ্নি-সংযোগের পাশাপাশি ‘লুট’ করাটাও দেশপ্রেমের বিধান কিনা।
আরো যেটা বিস্ময়ের বিষয় সেটা হচ্ছে যে ‘প্রথম আলো’ ও ‘দ্য ডেইলী স্টার’ গত ১৫ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের কড়া সমালোচনা করে এসেছে। গত বছরের জুলাইয়েও এই দুই পত্রিকা অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষেই ছিল। তবে, তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর সময়ে এই দুই পত্রিকার উপর এমন কোন হামলা, অগ্নি-সংযোগ বা লুটপাট অথবা পত্রিকার সামনে গরু জবাই করে ‘জেয়াফত’ খাবার ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া, গতকাল ময়মনসিংহের ভালুকায় অন্তর্জাল শিক্ষারহিত এক হিন্দু কারখানা শ্রমিককে পেশাগত হিংসা থেকে মিথ্যা ইসলাম অবমাননার নামে হত্যা করে, গাছে ঝুলিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে, সেটা রেকর্ড করার সময় শত শত মানুষ ধর্মীয় শ্লোগান দেয়। খুলনা ও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ ও ‘প্রথম আলো’ অফিস পোড়ানো-গুঁড়ানোর পাশাপাশি বত্রিশ নম্বর তৃতীয়বারের মত বুলডোজারে গুঁড়িয়ে সেখানে ‘হাদি সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ গড়া হয়েছে।
এবার ওসমান হাদি প্রসঙ্গ। বরিশালের ঝালকাঠির এক মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসা শিক্ষক বাবার ঘরের সন্তান শরীফ ওসমান হাদি ছয় ভাই-বোনের ভেতর সবার ছোট ছিলেন। স্থানীয় ‘ঝালকাঠি এন,এস, কামিল মাদ্রাসায় উচ্চ মাধ্যমিকের সমতূল্য আলীম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হাদি ২০১০-১১ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সম্প্রতি তিনি ‘ইউনিভার্সিটি অফ স্কলার্স’ নামে ঢাকাস্থ এক প্রাইভেট ভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর তিনি ‘ইনকিলাব সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ গড়ে তোলেন।
সামাজিক মাধ্যমের অসংখ্য কনটেন্ট থেকে খুব সম্প্রতি খানিকটা পরিচিত হয়ে ওঠা ওসমান হাদিকে মনে হয় এক দ্বি-বিভাজিত সত্ত্বা। কখনো তিনি ধানমন্ডি-৩২ থেকে শুরু করে নানা জায়গায় মব আক্রমণের নেতা। তীব্র ভাবেই আওয়ামী লীগ (হাদির ভাষায় ‘ফ্যাসিবাদী দল’) ও ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ’ বিরোধী হাদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠিন বাচনিক আক্রমণ করেন। আবার সেই তিনিই কখনো কখনো কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি করছেন বা কবিতার বই প্রকাশ করছেন। হয়তো শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি সুপ্ত আকাঙ্খা থাকলেও হাদির জন্মসূত্রে প্রাপ্ত পারিবারিক আবহ তাকে কঠোর ডানপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানের দিকেই ঠেলে দিয়েছিল। সেটা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। কারণ একটি দেশে ডান-বাম-মধ্যপন্থী সব দলই থাকে। আর তাই তরুণ হাদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যত কড়া ভাষায় আক্রমণ করুন না কেন, হাদির প্রতি সঙ্ঘটিত হত্যা-প্রচেষ্টা ও শেষমেশ হাদির মৃত্যু সুস্থ চিন্তার কোন নাগরিককেই খুশি করতে পারেনি।
কিন্তু হাদির সমর্থকরা শোকের ভাষা প্রকাশে যা যা করেছে- দেশের দুই বৃহত্তম পত্রিকা তথা এ সরকারেরই নিবেদিততম, দুই সমর্থক পত্রিকার উপর এমন ভয়ানক আক্রমণ, ‘ছায়ানট’-এ হামলা, আজ সন্ধ্যায় ‘উদিচী’তে হামলা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ভারতীয় দূতাবাসে হামলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর ক্যান্টিনের সামনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী (অবশ্যই গুজরাট দাঙ্গায় মোদির সম্পৃক্ততা নিয়ে বেদনা থাকতে পারে)-র ছবি পদদলিত করা, বিদ্যমান সরকারের অন্যতম অংশীজন হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তৃতায় ভারতের ‘সেভেনে সিস্টার্স’ আক্রমণের হুমকি প্রদান সহ বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে এমন আগ বাড়িয়ে আগ্রাসী আচরণ নিত্য দিনের পেঁয়াজ জাতীয় পণ্য থেকে শুরু করে শুধুমাত্র স্বাস্থ্য সেবার জন্যই কোটি কোটি বাংলাদেশীর তুলনামূলক কম খরচে শেষ ভরসার আশ্রয়স্থল ভারতকে ক্রুদ্ধ করা বাংলাদেশীরা নিজেরাই সইতে পারবে ত’? ভারতীয় দূতাবাস গতকাল থেকে ভিসা অফিস বন্ধ করে দিচ্ছে। অথচ, এ বছরের জুলাইয়েও দেখেছি যে ভেলোরে যাবার পথে পুরো বিমান বোঝাই বাংলাদেশী রোগীরা যাচ্ছেন। সেটা গত বছর ‘ইন্দিরা গান্ধী সংস্কৃতি কেন্দ্র’-এ হামলার পরও ভারত কিন্ত এটুকু বিবেচনা করেছে! আজ যারা রাস্তায় এসব করছে, আগামীকাল তাদেরই পরিবারের কারো কোন জটিল রোগে ভারতে যেতে হলে কী করবেন এটা কি ভেবে দেখা হচ্ছে? এমনকি হাদিকে নিতে হয়েছে ভারতীয় বিমানে করে, সিঙ্গাপুরে তামিল বংশোদ্ভুত ডাক্তারই হাদিকে দেখেছেন।
হয়তো ধর্মীয় কারণেই বাংলাদেশের বহু সংখ্যাগুরু নাগরিকই আজ পাকিস্থান থেকে পৃথক হওয়াটা মানসিক ভাবে মেনে নিতে কষ্ট পান। সত্যি বলতে, পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলিমই পাকিস্থান আন্দোলনের মূল নির্মাতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন পাকিস্থান আন্দোলনের অন্যতম যুব নেতা ও সংগঠক যিনি পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য জেলও খেটেছেন। কিন্তু, ১৯৪৭-৭১ নাগাদ পশ্চিম পাকিস্থানের উর্দূভাষী মুসলিম সংখ্যালঘুদের কাছে চাকরি-ব্যবসা সহ জীবনের প্রতি পদে পদে বঞ্চিত ও অবমানিত বাঙালি মুসলিম গড়ে তুলেছিল তার ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যার পেছনে তরুণ মুজিব তাঁর জীবন-যৌবন ঢেলে দেন (দ্রষ্টব্য: অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা)।
দীর্ঘ বছর কারাগারে থেকে ব্যক্তি মুজিবের অসীম আত্মদানের পাশাপাশি ১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও ১৯৭০-এর নির্বাচনী ফলাফলকে পশ্চিম পাকিস্থানী শাসকচক্রের অস্বীকার ও বাঙালি দমনের উদ্দেশ্যে ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ নিরীহ বাঙালির উপর সশস্ত্র পাকবাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং ন’মাস ব্যাপী যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির হত্যা ও দুই থেকে চার লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সামান্য পরে বা ১৯৭২ থেকেই এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমের মনেও পুনরায় ভারতবিদ্বেষ ও পাকিস্তানপ্রীতির যে জোয়ার দেখা দিতে থাকে, তা’ অতীতে শতাব্দীর পর শতাব্দী হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রমে পীড়িত অন্ত্যজ জনগোষ্ঠিসমূহের নতুন ধর্ম গ্রহণ সত্ত্বেও বৃটিশ ভারতের দীর্ঘ সময়ে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’-এ লাভবান হিন্দু জমিদার শ্রেণির উদ্ভব (বৃটিশ একই চতুরতায় উত্তর ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুর পাশে মুসলিম অভিজাতদের বেশি জমিদারি দিয়েছে যাতে করে ভূ-স্বামী ও প্রজার অর্থনৈতিক দ্বন্দ ধর্মীয় দ্বন্দের রূপ নেয় ও বাংলার অভিজাতের মত উত্তর ভারতের অভিজাত মুসলিমকেও বিপুল সংখ্যায় পাকিস্তানে পাড়ি দিতে হয়েছে; পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা আগে গ্রহণের সুবাদে অগ্রসরমান প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্তের পাশে নিজেকে হীনন্মন্য ভাবা থেকেও বাংলাদেশে জনমনে এই সদা ভারত ও হিন্দুভীতি উদ্ভুত কিনা- এসব ইতিহাসের অনেক জটিল প্রশ্ন)।
যদিও ভারত বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ বা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেই সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে এবং বঙ্গবন্ধু ‘সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা’, মাদ্রাসা শিক্ষাকে স্বীকৃতি প্রদান, ১৯৭৪ সালে ওআইসি-তে যোগ দান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশী শ্রমিক পাঠানোর মত অনেক পদক্ষেপই নিয়েছিলেন সংখ্যাগুরুকে খুশি করতে, তথাপি যে কোন কারণেই হোক জনমনে ভারতভীতি এবং আওয়ামী লীগ ও মুজিববিদ্বেষই প্রবলতর হতে থাকে।
যে বাঙালি মুসলিম শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসরমান প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের ভয়ে ১৯৪৬-এ কলকাতার দাঙ্গা বা নোয়াখালির দাঙ্গায় অংশ নিয়ে দেশভাগ তরান্বিত করেছে (শুনতে যত মন্দ লাগুক), তারাই পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিমের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ে সর্বাত্মক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে, স্বাধীনতার পরমূহুর্ত থেকে যুদ্ধে সর্বাত্মক সাহায্যকারী ভারতের প্রতি প্রচন্ড বিরূপ হয়েছে, এটা পূর্ব বাংলার ক্রমপরিবর্তমান জলবায়ুর প্রভাবে সে মানসিক ভাবে সদা অস্থির বা অতি চঞ্চল কিনা অথবা সে প্রতিযোগিতার কঠিন ও দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে ভয় পায় বলে আগ্রাসনকে সহজ পন্থা বলে মনে করে কিনা এই ঐতিহাসিক প্রশ্ন তোলার সময় বোধ করি এসেছে। পাশের দেশ ভারত বা শ্রীলঙ্কাই শুধু নয়, পাকিস্তান-আফগানিস্তানই শুধু নয়, এমনকি ভুটান বা নেপালের নাগরিকেরাও আন্তর্জাতিক নানা ‘হোয়াইট কলার’ চাকরিতে বাংলাদেশীদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছেন। এমনকি ১৯৭০-৯০ বা শুন্য দশকেও বা আওয়ামী লীগ-বিএনপির শাসনেও একজন মধ্যবিত্ত তরুণ বা তরুণী প্রমিত বাংলা, কিছুটা শুদ্ধ ইংরেজি জানবেন, কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নেবেন ও দৃষ্টি-শোভন পোশাক-পরিচ্ছদ পরবেন, এটাই ছিল কাঙ্খিত।
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের উত্থানের সময় থেকে একদিক থেকে তদানীন্তন সরকার তাদের সাহায্য করার পাশাপাশি অন্তর্জালে প্রচুর বামপন্থী নেটিজেন মাদ্রাসা ছাত্রদের পোশাক-পরিচ্ছদ, ভুল উচ্চারণের বাংলা, শিল্প-সংস্কৃতির সাথে যোগহীনতাকে মহিমান্বিত করে উল্টো বাঙালি মধ্যবিত্তের ভেতর সেই পাকিস্তান আমলেও যেমন সুরুচিসম্পন্ন সাদা-কালো বাংলা ছবির যে সুস্থ মধ্যবিত্ত পাত্র-পাত্রীদের দেখা যেত, সেই যাবতীয় সাংস্কৃতিক মানকেই ‘ফ্যাসিবাদ’, ‘সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ,’ ‘ভারতীয় আধিপত্য,’ ‘হেজিমনি,’ ‘লীগের দালালিপনা’ লিখে লিখে এত ‘দানবীয়করণ’ করা হয় যে আজ বোরখা পরিহিতা নারীদের মুখেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠিন যৌনগন্ধী গালি দেওয়া, ভুল বাংলা বলা ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ঘৃণা করাই যেন ‘গরিমা’। তবে কমলকুমার মজুমদারের লেখায় ‘কোথাও মায়া রহিয়া গেলো’র মত ‘কোথাও কিন্তু রহিয়া গেলো’।
সর্বহারা নেতা সিরাজ শিকদারকে এক কৃষক বলেছিলেন যে সব মানুষ সমান হলে সিরাজ কি তার নিরক্ষর কন্যাকে বিয়ে করতে পারবেন? লজ্জিত সিরাজ কৃষকের মেয়েকে বিয়ে করলেও পরে এক মধ্যবিত্ত, শিক্ষিতা নারীর প্রেমেই পড়েন। এখন যে বামরা গত পনেরো বছর ধরে শিক্ষাহীন এক ভয়ানক মবকে এত গরিমান্বিত করলো, তারা নিজেরা কিন্তু কটকী শাড়ি পরা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নেয়া নারীকেই বান্ধবী বা স্ত্রী হিসেবে পাশে চায়। সাংবাদিক জাইমার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়ে বলি যে সমাজের বিত্তশালী অংশের ইংরেজি পত্রিকা ‘স্টার’-এর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে ওড়নাহীন পশ্চিমা পোশাকে নারী কর্মীদের সমস্যা না হলেও ওনার জুলাই সহযোদ্ধাদের আশি শতাংশ ইসলামিস্টের কাছে ওনারা কিন্তু ‘মন্দ, চরিত্রহীন নারী’- শুধুমাত্র পোশাকের জন্যই। ইরান বিপ্লবেও বহু বাম নারী খোমেনীর সাথে ছিলেন। এবং ইরানেও আপাদমস্তক কালো বোরখাকে বাধ্যতামূলক করতে কয়েক বছর লেগেছিল।
গত রাতে যা হয়েছে তা’ কি ‘বিরোধিতার জন্য বিরোধিতাকারী’ বাম সহ সুবিধাবাদী নাগরিক মধ্যবিত্তকে ভাবাবে? কিন্তু এই দেশের কোটি কোটি মানুষ এখন পরিচালিত হচ্ছে প্রবাসী কতিপয় গালিবাজ ইউটিউবারের কথায়।
অনেকটা সময় আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেই। আজ জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থক ‘সিপিবি’-র উদীচি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে আগুন দেয়া হয়েছে। অশিক্ষা ও হিংসাকে যে বামরা ‘নিম্নবর্গের প্রতিরোধ’ বলে গত ১৫ বছর ধরে মহিমান্বিত করেছে, জাতীয় পতাকাকে জায়নামাজ বানিয়ে পদদলিত করাকে গরিমা দিয়েছে, তাদের সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই যে লেনিন কিন্তু মনে করতেন যে বিপ্লব মানে সমাজের সুশিক্ষিত, সুসংস্কৃতের ‘গালিবাজ’ হওয়া নয়, বরং তাঁর রাষ্ট্রের শ্রমিকও যেন তলস্তয় পড়তে পারেন বা বলশয় ব্যালে উপভোগ করতে পারেন, এটাই বিপ্লব।
এত হট্টগোলের ভেতর ওসমান হাদি হত্যাকান্ডের খুনীরাই শুধু ধরা পড়ছে না বা সুষ্ঠু, প্রকৃত তদন্ত হচ্ছে না। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই গত বছরের মত এবছরও পরাজিত প্রতিপক্ষের পাল্টা বয়ান তৈরির প্রচেষ্টা ও সারা দেহে মরণব্যথা ওঠার প্রকাশ দেখা গেলো। এই মরণব্যথা বোঝা খুব কঠিন ত’ নয়। কিন্তু, জুলাইয়ে রাতারাতি সরকারী নানা সংস্থায় বড় চাকরি যারা পেয়েছে, তারা লাহোর বা রাওয়ালপিন্ডি গিয়ে এই চাকরিগুলো পাবে ত’?
গত দেড় বছরে অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়তে থাকা বিদ্যমান অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি ছাড়া নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকার কোন ন্যায্য বৈধতাও বস্তুত: নেই। সব মিলিয়ে এ যেন সুইডিশ চলচ্চিত্রকার ইঙ্গমার বার্গম্যানের চলচ্চিত্র ‘দ্য সেভেন্থ সীল’-এ মধ্যযুগের ইউরোপের গির্জায় ‘দন্স ম্যাকাবের’ বা ‘মৃত্যুর সাথে নৃত্য’ বা সত্যজিতের ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’-য় ভূতের নাচ চলছে সারা দেশে।
১৯/১২/২০২৫