সর্বশেষ

ফাঁদের ভেতর বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৩০
ফাঁদের ভেতর বাংলাদেশ

“যাহারা জামায়াত-শিবিরের ফাঁদে পড়িয়াছিল, তাহারা আজ নীতিবাগীশ; আর যাহাদের এক পা এখনও ফাঁদে, তাহারা অন্তর্বর্তীকালীন নৈতিকতার লাইসেন্স হাতে নিয়ে রাষ্ট্র উদ্ধার করিতে নামে যদিও দড়ির টান যে কোথা হইতে আসিতেছে, সে খবর জানিবার সাহস তাহাদের নাই।”এই বাক্যটি আজকের বাংলাদেশের একাংশ বুদ্ধিজীবীর রাজনৈতিক দৃষ্টিহীনতার সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত প্রতিচ্ছবি।

 

চব্বিশের আন্দোলনের দিনগুলোতে আমরা দেখেছি মাঠে স্লোগান, মঞ্চে আবেগ, আর পর্দার আড়ালে নিখুঁত কৌশল। যে আন্দোলনকে ‘সাধারণ ছাত্র-জনতা’র স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ বলে উপস্থাপন করা হয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে দিয়েছে অন্য এক মানচিত্র। এখন স্পষ্ট এই ঢেউয়ের ভেতরে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিরোধী জামায়াত–শিবির নিজেদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির নকশা এঁকেছে; আর  অনেক বাম বুদ্ধিজীবী সেই ঢেউয়ের ফেনায় ভাসমান নৈতিকতার সনদ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দড়ির টান কোন দিক থেকে আসছে সে প্রশ্ন তোলার সাহস না দেখিয়ে।

 

ট্রাজেডিটা এখানেই। যারা একসময় মানুষকে ইতিহাসের কঠিন ও সত্য পাঠ শেখাতেন, তারাই আজ ইতিহাসকে ভেঙে–চুরে তুলে ধরছেন। ‘সাধারণ জনতা’—এই শব্দটি ব্যবহার করে বাস্তবের সব জটিল প্রশ্ন আড়াল করা হয়েছিলো। আর এখন তো প্রশ্ন করা  মানেই অপরাধ, সন্দেহ প্রকাশ করলেই শত্রু বানিয়ে দেওয়া হয়। কেউ যদি জানতে চায় এই আন্দোলনের পেছনে কারা সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণ করেছে, সে সঙ্গে সঙ্গেই ‘দুশমন’ হয়ে যায়। ফলে চিন্তা ও বিশ্লেষণের জায়গা দখল করেছে সোশ্যাল মিডিয়ার অভ্যাস। আবেগ থাকলে লাইক, আর প্রশ্ন তুললে ব্লক।  

 

চব্বিশের আন্দোলন যে জামায়াত–শিবিরের সংগঠিত রাজনীতির জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ ছিল, তা এখন অস্বীকার করা মানে চোখ খুলে অন্ধ থাকা। ‘সাধারণ ছাত্র-জনতা’র ব্যানারের আড়ালে ক্যাডার কাঠামো,অর্থের স্রোত,স্লোগানের ফ্রেম সবই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বললেন এরাই তো ‘জনগণ’! যেন ‘জনগণ’   কখনো সংগঠিত হয় না,কখনো ব্যবহার হয় না,কখনো মুখোশ পরে না। এই সরলীকরণই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দেখতে না পাওয়ার ব্যর্থতা।

 

নীতিবাগীশেরা তখন নৈতিকতার রেফারি হয়ে বসেছেন। কে ভালো, কে মন্দ—সবাইকে নম্বর দিচ্ছেন। কিন্তু মাঠে খেলোয়াড় বদলে যাচ্ছে, সেটা তারা টেরই পাচ্ছেন না। কারণ তাদের এক পা এখনো ফাঁদে সেই ফাঁদ সুবিধাবাদের। তাই যে প্রশ্নটি সবচেয়ে জরুরি ছিল-এই আন্দোলনের লাভ আসলে কার? সেটা কেউ তুলল না বরং বলা হলো, এমন প্রশ্ন তোলাই নাকি ‘লীগ’-এর দালালি। আর এখানেই ছিল আসল প্রতারণা। এই প্রতারণা শুধু রাজনীতির নয়, চিন্তা ও বুদ্ধিরও। দেশের বেশিরভাগ মানুষ তখন এই সূক্ষ্ম খেলাটা বুঝে উঠতে পারেনি। কারণ যাদের কাজ ছিল পথ দেখানো, তারাই চোখে রুমাল বেঁধে লোক দেখানো নাচে মেতেছিল। আজ সেই ভুলের মূল্য দিচ্ছে পুরো বাংলাদেশ। দেশ এখন রাজনৈতিক বিভাজনে ছিন্নভিন্ন, নৈতিকতা ভেঙে পড়েছে, আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভারে সবাই ভারাক্রান্ত।

 

হাসিটা তাই আজ বিষাক্ত। কারণ হাসতে হাসতে আমরা বুঝি নীতির বুলি দিয়ে  রাজনীতি করলে রাজনীতি পাল্টায় না; ক্ষমতার গণিত না বুঝলে নৈতিকতা হয়ে যায় সাজসজ্জা। চব্বিশ আমাদের শেখাল ‘সাধারণ জনতা’ কোনো নির্দোষ শব্দ নয়; এটি কখনো ঢাল, কখনো মুখোশ। আর বুদ্ধিজীবীর কাজ ঢাল ধরা নয়, মুখোশ খুলে দেওয়া। যদি এই শিক্ষা আমরা না নিই, তবে আবারও কেউ ‘সাধারণ’ নামে ভবিষ্যৎ রাজনীতি প্রসার ঘটাবে, আর আমরা আবার নৈতিকতার লাইসেন্স হাতে রাষ্ট্র উদ্ধার করতে নামব দড়ির টান কোথা থেকে আসছে, সে খবর জানার সাহস না নিয়ে।

সব খবর