সর্বশেষ

মতামত

শিবিরের বিজয় আর সুশীলদের শোক—এক নাট্য মঞ্চের ব্যঙ্গচিত্র

প্রকাশিত: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:৪৭
শিবিরের বিজয় আর সুশীলদের শোক—এক নাট্য মঞ্চের ব্যঙ্গচিত্র

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের বিজয়ে যেন সুশীল-কুশীল সমাজের মাথায় আকাশের খুঁটি ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম। কেহ বলিতেছেন—এ এক নীলনকশার সাফল্য, কেহ বলিতেছেন—দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ফল, কেহবা আবার বিজীত দলগুলোর ব্যর্থতা বিশ্লেষণে ব্যাতিব্যস্ত। গবেষণার নামে চলিতেছে গণতন্ত্রের পোস্টমর্টেম। জনতার মনোভাব বুঝিতে গিয়া সমাজতাত্ত্বিকের ঘাম ঝরিতেছে, অথচ আয়নার দিকে তাকাইতে রাজি নন কেহ।

 

বিগত এক যুগ ধরিয়া আমাদের সমাজে যে ধর্মীয় আচারের স্রোত বহিয়া গিয়াছে, তাহার দায় কি কেবল শিবিরের? আমাদের অলিতে গলিতে মাদ্রাসা গড়িয়া উঠেয়াছে, আমরা বাড়তি ভাড়ার আশায় দোতালা-তিনতালা ভাড়া দিয়া মজা লুটিয়াছি। ঘুষের টাকায় মসজিদে এসি লাগাইয়াছি, হারাম টাকায় এতিমখানায় মিলাদ দিয়াছি, দূর্নীতির টাকায় খতম পড়াইয়াছি, ফ্ল্যাটের সেমিনার হলে মসজিদ বানাইয়া ইমাম নিয়োগ দিয়াছি, সকাল বিকাল মাহফিল জমাইয়াছি। এইসব কর্মকাণ্ডে আমরা সকলে অংশ নিয়াছি সত্য, কিন্তু দায় নিতে কেহই রাজি নই বৎস।

 

আমরা আমাদের সন্তানকে ইহকাল-পরকালের সেফটি সিকিউরিটির নামে মাদ্রাসায় বন্দোবস্ত দিয়াছি। ছেলে আট-দশটা প্রেম করিলেও বিবাহের সময় পরহেজগার নারী, ইসলামী শরিয়াতী পরিবার দেখিয়া বিবাহ দিয়াছি। আমাদের সন্তানকে ছোটবেলায়ই জামায়াতের হাতে, ধর্মান্ধ মোল্লার হাতে ইসলামের নামে তুলিয়া দিয়াছি। আর সেই শিশুটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়া শিবিরকে ভোট দিয়াছে, তখনই শুরু হইয়াছে 'হায় হোসেন' 'হায় হোসেন' বিলাপ।

 

এ এক অভিনব নাটুকেপনা। সুশীল সমাজের বিলাপ এখন রঙচঙে শোকের মাতমে পরিণত হইয়াছে। কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিতেছেন—“আমরা কোথায় যাইতেছি?”, কেউ টুইট করছেন—“গণতন্ত্রের অকাল মৃত্যু!” অথচ গণতন্ত্রের কবর যে আমরা নিজেরাই খুঁড়িয়াছি, তা স্বীকার করিতে নারাজ।

 

শিবিরের বিজয় কোনো দৈব ঘটনা নহে। এটি ধারাবাহিক সামাজিক নির্মাণের ফল। আমরা যে সমাজে ধর্মীয় পরিচয়কে অগ্রাধিকার দিয়াছি, যেখানে ধর্মের নামে ব্যবসা, রাজনীতি, প্রেম, বিবাহ, এমনকি মৃত্যুও পরিচালিত হয়—সেই সমাজে শিবিরের বিজয়ে অবাক হইবার কিছু নহে।

 

এখন যাহারা গবেষণায় লিপ্ত, তাহারা যেন ভুলিয়া না যান—এই সমাজের প্রতিটি ইট, প্রতিটি গাঁথুনি আমরা স্বহস্তে তৈয়ার করিয়াছি। আমরা যে মৌলবাদী, ওয়াহাবী সমাজের ভিত্তি রচনা করিয়াছি, তাহার ফলাফল আজকের ডাকসু।

 

তাই এই অশ্লীল আহজারি, এই নাটকীয় বিলাপ, এই কৃত্রিম শোকের মাতম—বড়ই হাস্যকর। বরং দরকার আত্মসমালোচনা, দরকার আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া নিজের মুখোমুখি হওয়া।

 

শিবিরের বিজয় আমাদের সমাজের আয়না। সেখানে আমরা সবাই আছি—আমাদের ভণ্ডামি, আমাদের দ্বিচারিতা, আমাদের সুবিধাবাদিতা। এই আয়নাকে ভাঙা নয়, বরং তাহার সামনে দাঁড়াইয়া নিজের মুখমন্ডল চিনিয়া নেওয়াই এখন জরুরি।

 

লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল; যে তাহার আপন শর্শীতে আসল বদন চিনিতে ব্যাকুল

সব খবর