জাতির উদ্দেশ্যে, বিশ্ব ফোরামে, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মিডিয়ায়, বিভিন্ন সভা-সেমিনার-বৈঠকে বারবার একটা কথাই ড. ইউনূস বলেছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বেই নির্বাচন, এর কোন বিকল্প নেই। কারো শক্তি নেই নির্বাচন পেছানোর। যতকিছুই ঘটুক না কেন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বে নির্বাচন হবেই হবে....
কতবড় চতুর, নির্লজ্জ, বেহায়া হলে এমনতর মিথ্যাচার করতে পারে! কেননা সংবিধানে আছে ৩ মাস আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। নভেম্বরের ৭ বা ১৫ তারিখ নয় গোটা মাসই শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তফসিল ঘোষণার কোন আওয়াজ নেই।
এদিকে বেচারা তারেক জিয়া এখনও বুঝতেই পারছে না ইউনূস তাকে কতবড় মূলা ধরিয়ে দিয়েছে! বিএনপি নানা ইস্যুতে এই তথাকথিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তীব্র সমালোচনা শুরু করেছিল। তারেক জিয়া নিজে আল্টিমেটাম দিয়েছিল ডিসম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু ইউনূসের ইচ্ছা ছিল জুনে নির্বাচন করার।
এরপর বিএনপির চাপে ইউনূস সুর নরম করে এপ্রিলে নির্বাচনের কথা জানান। ইউনূসের টালবাহানার কারনে বিএনপির প্রায় সকল শীর্ষনেতা একযোগে ক্ষেপে উঠলেন, ইউনূস গংয়ের নানা অপকর্মের কথা বলা শুরু করলো। অবস্থা বেগতিক দেখে গত জুনে ইউনূস তড়িঘড়ি করে সকল কূটনীতিক শিষ্টাচার উড়িয়ে দিয়ে উড়ে গিয়েছিল লন্ডনে, তারেক জিয়ার মুখে একটা চুষনি দিতে। অত:পর তিনি তাতে পুরোপুরি সফল হলেন। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বেই নির্বাচন হবে। দু'পক্ষই সন্তুষ্ট। তারেক জিয়া থেকে সকল শীর্ষনেতা মুখে কুলুপ আঁটলেন; আমাদের ইউনূস স্যার খুব ভালো! সকল সমালোচনা বন্ধ।
এরপর ইউনূস শুরু করলেন সংস্কার সংস্কার খেলা। আরেকদল জিকির উঠালো পিআর পদ্ধতির জন্য, গণভোট আগে না জাতীয় নির্বাচন আগে। বিএনপি মৃদু ধমক দিলো, গণভোট হলে নির্বাচনের দিনই হতে হবে। ১৩ই নভেম্বর সফল লকডাউনের দিনেই ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি বিএনপির দাবি মেনে নিলেন; বললেন, জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট এবং তা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বেই।
আবারও মিথ্যাচার। কেননা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বে নির্বাচন হলে ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। সে কথা কেউ মুখে তুলছে না। এমনকি গণভোট করতে রাষ্ট্র সংস্কারের মত জটিল বিষয়ে জনগণকে অবহিতকরণ ও গণসচেতনতা সৃষ্টি আদৌ সম্ভব কি না তাও এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু বিএনপি হাততালি বাজালো! তারা মনের খুশিতে সকল প্রচলিত সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ভেঙ্গে দুই শতাধিক আসনে নমিনেশনও ঘোষণা দিয়ে দিল! বাকি আসনের সিদ্ধান্ত না জানিয়ে বিভিন্ন দলের সাথে দেনদরবার চালাতে থাকে।
তারা মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি করলো না, কোন প্রার্থিতা আহ্বান, গ্রহণ, যাচাই-বাছাই কিচ্ছু করলো না। নির্বাচন কমিশনে প্রতিটি নিবন্ধিত দলের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট জমা দিতে হয়। আওয়ামী লীগের দলীয় ফান্ডের প্রায় সকল আয়ের উৎসই হচ্ছে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি। বিএনপি মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি করে প্রায় শতকোটি টাকা বৈধভাবে আয় করতো পারতো। সেটা কেন করলো না? নাকি যে পদ্ধতিতে মনোনয়ন দেয়া হলো তাতে আয়টা অবৈধ হলেও বৈধ আয়ের চেয়ে তা কযেকগুণ বেশী!
এদিকে গত একমাস ধরে বিএনপি'র দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ বললেন, নভেম্বরের প্রথমার্ধ্বেই তারেক জিয়া ফিরে আসবেন। এরপর বললেন শেষ সপ্তাহে। এখন শুনছি ডিসেম্বরে। তিনি কেন আসছেন না? কর্তারা কি এখনও ক্লিয়ারেন্স দেয়নি? এই কর্তারা কে? আমেরিকা, ভারত, জামাত-নিয়ন্ত্রিত ইউনূস সরকার নাকি সেনাবাহিনী?
বিএনপি'র মত একটি বড় রাজনৈতিক দল কীভাবে ইউনূসের মত মিথ্যেবাদীকে বারবার বিশ্বাস করছে তা তারেক জিয়াই জানে। যদি নির্বাচন হয়ও এটি একটি বিকলাঙ্গ নির্বাচন হবে, তা নিশ্চিত। কেননা তারা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন করতে দিবে না; মানে ৫০ শতাংশ ভোটারকে নির্বাচনের বাইরে রাখছে। বিএনপিও তাই চাচ্ছে। কিন্তু এমনতর একটি অবৈধ প্রহসনমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও বিএনপি সহজেই সরকার গঠন করবে, বিষয়টি কি এতটাই সহজ?
ইউনূসের মাস্টারপ্ল্যান বিএনপি এখনও বুঝতে পারছে না।
নির্বাচন দেরিতে হলে, দিন যত যাবে বিএনপির জনপ্রিয়তা ততই হ্রাস পাবে, জামাতের বাড়বে। এটার কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই কেননা মাঠ পর্যায়ের সকল বাণিজ্য বিষয়ক দখলদারিত্ব বিএনপির একক নিয়ন্ত্রণে। যেটা বরাবরই জনস্বার্থবিরোধী। জামাতের ধর্মীয় লেবাস ও ওয়েলফেয়ার রাজনীতির শিকড় এখন মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত। চাইলেই উপড়ানো সম্ভব নয়। আমলাতন্ত্র এখন জামাতের নিয়ন্ত্রণে। প্রথমদিকে সকল জেলার ডিসি-এসপি এবং সচিব নিয়োগ জামাত-বিএনপি ভাগাভাগি করে নিলেও, এখনকার নিয়োগ হচ্ছে প্রায় সকলই জামাতের প্রেসক্রিপশনে।
শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচনে শিবির জিতেছে। এরপর সকল কলেজের ছাত্রসংসদ নির্বাচনও দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে ইউনুস গং। প্রতিটি জেলা ও উপজেলার সরকারি কলেজগুলো যদি বৈধভাবে শিবিরের নিয়ন্ত্রণে যায় তাহলে বিএনপি'র অবস্থাটা কোথায় যাবে?
ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জেলায় শিবিরের সাবেক নেতারা জামাতের প্রার্থী হিসেবে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ওয়াজ-মাহফিল, কাওয়ালী সন্ধ্যা, বিভিন্ন প্রকারের সমাজসেবা ও মসজিদকেন্দ্রিক প্রচারণায় জামাত ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী একটি প্রকাশ্য শক্তিশালী ভিত তৈরি করেছে।
শিবির ও কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্য থেকে বাছাইকৃত সাড়ে ৮ হাজার যুবককে আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণ দেয়ার নামে মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করা হচ্ছে। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নেতৃত্বে যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে তৈরি করা হচ্ছে এই মিলিশিয়া বাহিনী। গত জুলাই-আগস্টে লুট করা পুলিশের অস্ত্র এবং আনসারের জন্য কিনতে যাওয়া ১৭,০০০ শটগান যে এই মিলিশিয়া বাহিনী ব্যবহার করবে না, তার গ্যারান্টি কি? এই বাহিনীকে নির্বাচনে ব্যবহার করবে বলেই কি এই সময়ক্ষেপন!
ড. ইউনূস যে কতবড় খেলোয়াড় এবং দিনশেষে একজন চৌকষ ব্যবসায়ী তা দেশবাসী কি এখনও তা বুঝতে পারছে না? নিজের নামে অসংখ্য ব্যবসা বাণিজ্য, করমুক্তি, বন্দর ইজারা...সেগুলোর হিসেব কে নিবে? তার পশ্চিমা প্রিন্সিপলদের অনেক এসাইনমেন্ট ও ব্যক্তিগত মিশন এখনও বাকি। তেল-গ্যাস, বন্দর, সোনাদিয়া, সেন্টমার্টিন, অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান কেনা...এগুলো নিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রিন্সিপলদের সন্তুষ্ট ও নিজের সর্ব্বোচ্চ আয়-বাণিজ্য নিশ্চিত করতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়ার লোক সে না। সর্ব্বোচ্চ সম্পদ আরোহন ও জামাতকে ক্ষমতায় বসানো নিশ্চিত না করা পর্যন্ত জাতির সামনে নির্বাচনের মূলা ঝুলিয়েই রাখবে।
একটি কালো চাদরে ঢেকে যাচ্ছে স্বদেশের মুখ।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বাঁচাতে ব্যর্থ হবে বিএনপি, এটা নিশ্চিত। মুক্তির একমাত্র উপায় এখনও দেশকে যারা মা বলে ডাকে, মুক্তিযুদ্ধের উপর আস্থাশীল সেই সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। যতক্ষণ না পর্যন্ত সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আদায় সম্ভব না হবে, এ আঁধার কাটবে না।