ঢাকা শহর আজও তীব্র যানজট, বেদখল ফুটপাত, দখলকৃত পার্ক ও মাঠ, এবং আবর্জনায় ভরা জলাশয়ের দুর্দশায় জর্জরিত। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘ন্যায্য ঢাকা’ গড়ার। অনেকেই ভেবেছিলেন রাজধানীর নগরশাসনে নতুন চিন্তার সূচনা হবে, কেউ কেউ এটিকে ‘মেটামডার্ন মিউনিসিপ্যালিজম’-এর সূচনা হিসেবেও দেখেছিলেন। কিন্তু নয় মাস পর বাস্তবতা হলো—প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক ব্যাপক।
মোহাম্মদ এজাজের প্রতিশ্রুতিগুলো কাগজে-কলমে আধুনিক শহর গড়ার বহুল আলোচিত তত্ত্ব ‘মেটামডার্ন নগরায়ণ’-এর সঙ্গে মিলে যায়। এ তত্ত্বে সম্পদের সমান বণ্টন, গণপরিবহনে ন্যায্য প্রবেশাধিকার, প্রকৃতি ও জনপরিসরকে জনসাধারণের সম্পদ হিসেবে রক্ষা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাগরিকদের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এসবের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এজাজের রিপোর্ট কার্ড এখনো শূন্য।
ডিএনসিসির বিভিন্ন স্থানে চলমান খোঁড়াখুঁড়ি নাগরিকদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। মিরপুর এলাকায় আইডিআরআইএসপি প্রকল্পের কারণে রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাত সংস্কারের কাজ ধুলাবালি ও জলাবদ্ধতার বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। সংকীর্ণ সড়ক, ফুটপাত দখল, মেট্রোরেল স্টেশনের ভিড় এবং অবৈধ পার্কিং মিলিয়ে যানজট অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।
প্রশাসক দাবি করেছেন জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে পুরনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও বর্জ্য জমে পানি নিষ্কাশন প্রায় বন্ধ। সামান্য বৃষ্টিতেই কাজীপাড়া থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত হাঁটু বা কোমরপানি জমে যায়। অপর্যাপ্ত ডাস্টবিন ও খোলা জায়গায় আবর্জনা ফেলার কারণে দুর্গন্ধ ছড়ায়, আর রাতের বেলা আলোর অভাবে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পার্ক-মাঠ উন্মুক্ত করা সহজ কাজ হলেও প্রশাসক ব্যর্থ হয়েছেন। শহীদ তাজউদ্দিন পার্কসহ বিভিন্ন পার্ক অভিজাতদের লিজ দেয়া হচ্ছে। ফলে সাধারণ নাগরিকদের প্রবেশাধিকার নেই। নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাঠ–পার্ক উন্মুক্তকরণ হলে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আসত।
বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজীব অভিযোগ করেন, মাঠ দখলকে বৈধতা দিতে লাইব্রেরি নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, “এটা এক ধরনের সিন্ডিকেট, যেখানে প্রশাসক এজাজও যুক্ত।”
প্রশাসক হওয়ার পর এজাজ ঘোষণা দিয়েছিলেন ফুটপাত দখল করলে ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হবে। কিন্তু কয়েক মাসের মাথায় সিটি করপোরেশন নিজেই ফুটপাত ভাড়া দিয়েছে। গুলশানের একটি সড়কে দৈনিক ভাড়া আদায় এবং নতুন বাজার এলাকায় সড়ক দখল করে ওয়ার্ড নির্মাণের ঘটনা ঘটেছে।
এজাজ প্রকৃতিকেন্দ্রিক নগর জীবন গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এ খাতে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এয়ার পিউরিফায়ার স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে তিনি পরিবেশবিদদের তোপের মুখে পড়েন। পরে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, “ঢাকাকে এখনো প্রকৃতিকেন্দ্রিক নগর হিসেবে বিকশিত করা সম্ভব হয়নি। গাছ, খাল, জলাধার দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।”
প্রশাসক হওয়ার আগে এজাজ খাল পুনরুদ্ধারের মডেল নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পর একটি খালও তিনি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “চমকপ্রদ শব্দ দিয়ে ঢাকার মতো জটিল নগরীর পরিবর্তন সম্ভব নয়।”
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা স্পষ্ট। ইকবাল হাবিব বলেন, “যে হারে মানুষ ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছে, যদি স্বাভাবিক সময় হতো তীব্র আন্দোলন দেখা যেত। এখন কোনো ক্রাশ প্রোগ্রামও নেই।”
মোহাম্মদ এজাজ দায়িত্ব নেয়ার পর ‘ন্যায্য ঢাকা’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু নয় মাস পর দেখা যাচ্ছে, নাগরিক ভোগান্তি, অবকাঠামোগত বিশৃঙ্খলা, জলাবদ্ধতা, পার্ক-মাঠ দখল, ফুটপাত দখল, প্রকৃতিকেন্দ্রিক নগর ব্যর্থতা এবং জনস্বাস্থ্য সংকট আগের মতোই চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেটামডার্ন তত্ত্বের প্রতিশ্রুতি বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। তাই প্রশাসকের রিপোর্ট কার্ড এখনো শূন্য।