বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র সার্ভারে অননুমোদিত প্রবেশ করে কোটি টাকার সরকারি অর্থ আত্মসাতের চেষ্টার ঘটনায় ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মোহাম্মদ মারুফ এলাহী রনিসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে অতিরিক্ত পরিচালক আবুল খায়ের মো. খালিদ রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
অপর তিন আসামি হলেন, মারুফ এলাহীর ব্যাংক হিসাব খোলার পরিচয় শনাক্তকারী মহিউদ্দিন আহমেদ, এনআরবিসি ব্যাংকের দিনাজপুর রানীগঞ্জ উপশাখার গ্রাহক মো. আরিফুর রহমান মিম এবং তাঁর পরিচয় শনাক্তকারী আল আমিন। পুলিশ ইতোমধ্যে আরিফুর রহমানকে মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রাথমিকভাবে তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলে জানা গেছে।
জালিয়াতির কৌশল: ইউজার আইডি দখল, তথ্য বদল, টাকা স্থানান্তর
এজাহার অনুযায়ী, আসামিরা জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের (NSC) অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে গোপনে প্রবেশ করে গ্রাহকদের মোবাইল নম্বর, ব্যাংক হিসাব নম্বর ও লেনদেন প্রোফাইল পরিবর্তন করেন। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইউজার আইডি ব্যবহার করে একাধিক সঞ্চয়পত্র নগদায়ন দেখিয়ে টাকা অন্য ব্যাংকে পাঠানো হয়।
২৩ থেকে ২৭ অক্টোবরের মধ্যে তিনটি সঞ্চয়পত্রের তথ্য টেম্পারিং করে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও এনআরবিসি ব্যাংকের হিসাবে মোট ৭৫ লাখ টাকা স্থানান্তরের চেষ্টা হয়। এর মধ্যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের হিসাব থেকে ৫০ লাখ টাকা পাঠানো হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে টাকা আটকে ফেলে এবং ইএফটির মাধ্যমে সরকারি খাতে ফিরিয়ে দেয়।
জালিয়াতির প্রথম ধাপ ধরা পড়ে মহাহিসাব নিরীক্ষণ কার্যালয়ের কর্মকর্তা এস এম রেজভীর ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর ঘটনায়। তিনি আয়কর রিটার্ন দিতে গিয়ে দেখেন, তাঁর সঞ্চয়পত্র আগেই নগদায়ন দেখাচ্ছে অথচ তিনি আবেদন করেননি। যাচাই করে দেখা যায়, ২২ অক্টোবর তাঁর ব্যবহার করা মোবাইল নম্বর ও ব্যাংক হিসাব পরিবর্তন করা হয়েছে এবং ২৬ অক্টোবর অর্থ এনআরবিসি ব্যাংকের আরিফুর রহমান মিমের হিসাবে যায়।
সাধারণত আরিফুরের অ্যাকাউন্টে জমা–উত্তোলনের সীমা ২ লাখ টাকা; অথচ জালিয়াত চক্র তা বাড়িয়ে ১০ লাখ করে। এরপর ঢাকার দুটি শাখা থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়।
ছাত্রদল নেতার নামে ৫০ লাখ টাকা
ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মারুফ এলাহী রনির ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার হিসাবে ৫০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছিল দুইটি সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে—৩০ লাখ টাকার সাইদুর রহমান ও ২০ লাখ টাকার আবুল হাসান মজুমদারের নামে। উত্তোলনের আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা আটকে দেয়।
যোগাযোগ করা হলে মারুফ এলাহী রনি দাবি করেন, ঘটনাটি তিনি জানেন না। তাঁর হিসাবে লেনদেন সীমা ৫ লাখ, বর্তমান স্থিতি মাত্র ৩৫ হাজার টাকা। রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তদন্ত ও নিরাপত্তা জোরদার, সারাদেশে সঞ্চয়পত্র কার্যক্রম বন্ধ
ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বিএফআইইউ ও এনআরবিসি ব্যাংক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। মতিঝিল অফিসে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ডধারী তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং কম্পিউটার জব্দ করা হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যাংক হিসাবগুলো ইতোমধ্যে জব্দ করেছে বিএফআইইউ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে সঞ্চয়পত্র কেনা–বেচা বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহকরা। দেশে মোট ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র চালু রয়েছে, যার প্রায় ৩০%ই পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। নতুন ইউজার আইডি-পাসওয়ার্ড ইস্যু হওয়ায় কাজ স্বাভাবিক হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।