বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দেড় বছর ধরে এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, ঋণ প্রবাহ হ্রাস এবং আমদানি-রপ্তানিতে স্থবিরতা ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে সমানভাবে চাপে ফেলেছে। শিল্প-বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকারের দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতিও অস্পষ্ট।
ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ও কর কাঠামো সহজ করার দাবি জানালেও তা উপেক্ষিত। শিল্পাঞ্চলে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ টেকসই করার আলোচনাও কার্যকর হয়নি। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রতিযোগিতা বাড়ানোর মতো মৌলিক বিষয়গুলো আলোচনার বাইরে থেকে গেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি মসৃণ গণতান্ত্রিক রূপান্তর ছাড়া ব্যবসা-বিনিয়োগে আস্থা ফিরবে না। গণতন্ত্র সিন্ডিকেট ভাঙতে, প্রতিযোগিতা বাড়াতে এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সহায়ক। নির্বাচিত ও বৈধ সরকার প্রতিষ্ঠা হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমবে, যা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করবে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই–অক্টোবর) সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার নিট ২,৩৬৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত অর্থবছরে নিট ঋণ ছিল ঋণাত্মক, প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। অক্টোবর শেষে সঞ্চয়পত্রে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাত থেকেও সরকার বিপুল ঋণ নিচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার নিয়েছে ৪৫ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল ৭২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষায় দেখা গেছে, অন্তত ৪২টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চরম আর্থিক ঝুঁকিতে রয়েছে। মোট ১০১টি সংস্থার দেনা ও সম্ভাব্য দায় বিশ্লেষণে উচ্চ ঝুঁকি ধরা পড়েছে। ফলে সরকারের আর্থিক চাপ আরও বেড়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় ৫ শতাংশ বাড়তে পারে। তবে এর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ এবং শিল্পাঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। পরিকল্পনা কমিশনের নতুন অর্থনৈতিক সংকলনেও সতর্ক করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক পালাবদল ও কাঠামোগত দুর্বলতা অর্থনীতির গতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
ব্যবসায়ীরা তাই অপেক্ষায় আছেন নির্বাচনের পর একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য, যা বিনিয়োগে আস্থা ফিরিয়ে আনবে এবং শিল্প-বাণিজ্যে নতুন গতি সঞ্চার করবে।