সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, সাদা পোশাক পরিহিত এক বৃদ্ধ সাধুকে কয়েকজন যুবক জোরপূর্বক ধরে চুল কেটে দিচ্ছেন। মুক্ত হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার পর অসহায় বৃদ্ধ কণ্ঠে আর্তনাদ করে বলেন— “আল্লাহ তুই দেহিস।”
ময়মনসিংহ বাউল সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আসলাম নিশ্চিত করেছেন, ভুক্তভোগীর নাম হালিম উদ্দিন আকন্দ (৭০)। তিনি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কোদালিয়া কাশিগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা এবং হজরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহ পরান (রহ.)-এর ভক্ত, নকশবন্দিয়া তরিকার অনুসারী। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে তিনি চুলে জটা রেখে আসছিলেন। একসময় কৃষিকাজে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করছেন।
ঈদুল আজহার আগের দিন কাশিগঞ্জ বাজারে ঘুরতে গিয়ে কয়েকজন বিশেষ পোশাকধারী ব্যক্তি তাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে এবং “সামাজিক কাজের” নামে তার জটা কেটে দেয়। স্থানীয়রা বাধা দিলেও অভিযুক্তরা তা অগ্রাহ্য করে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয় যুবক হাসিবুর রহমান জুয়েল জানান, অন্তত তিনজন ব্যক্তি এই কাজ করছিলেন এবং তাদের একজন ভিডিও ধারণ করছিলেন।
এরপর থেকে হালিম উদ্দিন শারীরিক ও মানসিক কষ্টে ভুগছেন। তার ছেলে হাবিবুর রহমান বলেন, “আমরা সামাজিকভাবে অপমানিত হয়েছি। এখনো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছি।”
ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ময়মনসিংহ বাউল সমিতি ও ময়মনসিংহ সংস্কৃতি সমাজ দ্রুত দোষীদের বিচারের দাবি করেছে। বাংলাদেশ সুফিবাদ ঐক্য পরিষদও কঠোর আইনি পদক্ষেপ চেয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে এটিকে “অমানবিক, বেআইনি এবং সংবিধান ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন” উল্লেখ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
তদন্তে উঠে এসেছে, ‘হিউম্যান সার্ভিস বাংলাদেশ’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে এ ধরনের বহু ভিডিও পোস্ট করা হয়, যেখানে প্রচলিত জীবনধারার বাইরে থাকা মানুষদের ধরে জোরপূর্বক চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়। জনৈক সাংবাদিক ইমরান হোসেন ফেইসবুকে জানান, এই পেজের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে আছেন মুফতি সোহরাব হোসেন আশরাফি ও আফসার, যারা মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় থাকেন।
এছাড়া কুমিল্লার মাহবুবুর রহমান নামের আরেক যুবক ‘মাহবুব ক্রিয়েশন’ ও ‘স্ট্রিট হিউম্যানিটি’ নামে পেজ থেকে একই ধরনের ভিডিও ছড়াচ্ছেন। তিনি দাবি করেন, ভারতীয় একটি ভিডিও দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২২ সাল থেকে এই কাজ করছেন এবং প্রবাসীদের সহায়তায় ঢাকার বাইরে গিয়েও এসব কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
বাউল শিল্পী শফি মণ্ডল বলেন, “চুল-দাড়ি সাধনার ফল, জোর করে তা কেটে দেওয়া ভয়ংকর কষ্টের। ধর্মের নামে মানুষের মনে আঘাত দেওয়া কোনোভাবেই মানবতার কাজ নয়।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “এটি মৌলিক অধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা বেআইনি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিককে রক্ষা করা, কিন্তু প্রশাসন ও মন্ত্রণালয় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।”
বাংলাদেশে সুফি, বাউল ও সাধকদের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক চুল-দাড়ি কাটার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের অভাবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়ে চলেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এ ধরনের অমানবিক কাজ আরও বিস্তার লাভ করবে।