সুদান আজ মানবতার সবচেয়ে অন্ধকার সময় পার করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভাষ্যে যে নৃশংসতা দেশটিতে চলছে, তা আধুনিক পৃথিবীতে অকল্পনীয়। মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় সেখানে হত্যা করা হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি বেসামরিক মানুষকে। হত্যা করা হয়েছে প্রসূতি হাসপাতালের চিকিৎসাধীন নারী, নবজাতক এবং অসহায় রোগীদের। জাতিসংঘ এই পরিস্থিতিকে বলেছে “একটি অত্যাচারের যুদ্ধ”।
দীর্ঘদিন ধরেই দারফুর ও আশপাশের অঞ্চল যুদ্ধবিধ্বস্ত। তবে সর্বশেষ ভয়াবহতার কেন্দ্র উত্তর দারফুরের রাজধানী এল ফাশের। ১৮ মাস অবরোধের পর শহরটি নিয়ন্ত্রণে নেয় আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। সংস্থাগুলো বলছে, শহর দখলের পর আরএসএফ সদস্যরা নির্বিচারে বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা চালায়, বাড়িঘর ভাঙচুর করে এবং ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা করে।
হাসপাতালে গণহত্যা, মৃতদেহ ছড়িয়ে রাস্তায়
সাহায্য সংস্থা ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন—হাসপাতাল, স্কুল, বাড়ি—কোথাও রেহাই নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, নিরস্ত্র মানুষদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হচ্ছে। স্যাটেলাইট ছবিতে মিলেছে গণকবর ও পোড়া বাড়ির চিহ্ন।
সুদান নেটওয়ার্ক ডক্টরস জানায়—একটি প্রসূতি হাসপাতালে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ৪৬০ জনের বেশি মানুষ। নার্স নাওয়াল খলিল বলেন, “ওরা হাসপাতালে যে কাউকে দেখেছে তাকে গুলি করেছে। কয়েকজন আহত নারীকে বিছানায় হত্যা করা হয়। আমি জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাই।”
যৌন সহিংসতার ভয়াবহতা: শিশুদেরও রেহাই নেই
গৃহযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক যৌন সহিংসতা। নারী, কিশোরী, এমনকি শিশুদের ওপর অমানবিক নির্যাতন নিয়মিত ঘটনা। পুরুষদের বাধ্য করা হচ্ছে স্ত্রী, মা, কন্যাদের ওপর ধর্ষণ দেখতে।

ইউনিসেফ জানিয়েছে, এক বছর বয়সী শিশু পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুতে কমপক্ষে ২০০ শিশুর ধর্ষণ নথিভুক্ত করা হয়েছে।
আমিনা নামে ছয় সন্তানের এক মা বলেন, “আমার ছেলে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। ওরা বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে ওর মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। ১৭ দিন পরে সে মারা যায়।”
৩০ বছর বয়সী হামিদা বলেন, “ওরা আমাকে বেঁধে তিনজন মিলে ধর্ষণ করে। আমার ছোট মেয়েকে সে দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা হয়। আমি হাসপাতালে যাইনি—সমাজ ভয় পাবে বলে।”
আরএসএফ দখলে সেনাবাহিনীর শেষ ঘাঁটি
বিশ্লেষকরা বলছেন এল-শাফির শহর দখল করার মাধ্যমে আরএসএফ এখন কার্যত দারফুর অঞ্চলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক। সেনাবাহিনীর শেষ প্রতিরোধও ভেঙে গেছে। পালিয়ে যাওয়া মানুষদের ভাষ্য—পথজুড়ে মৃতদেহ, পুড়ে যাওয়া লাশ, ধ্বংসস্তূপ আর শিশুদের কান্নার দৃশ্যে অঞ্চলটি আজ মৃতভূমি।
বিশ্বের নীরবতা সবচেয়ে বড় বিপদ
জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো প্রতিষ্ঠানের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বিশ্ব নীরব। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, “পুরুষেরা হয় নিহত, নয়তো বন্দি বা নিখোঁজ। নারীরা পালাতে পালাতে মরছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া খুবই দুর্বল।”
সুদানের অস্থিরতার দীর্ঘ ইতিহাস
১৯৫৬ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশটিতে ২০টি অভ্যুত্থান, তিনটি বড় গৃহযুদ্ধ, এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমান যুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে, যখন সামরিক নেতা আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেদতি) ক্ষমতার লড়াইয়ে মুখোমুখি হন।