“আমি মরতে চাই, কিন্তু ত্তোকবোক্কি খেতে চাই” এই বাক্যটি শুধু একটি বইয়ের নাম নয়, বরং লাখো মানুষের মনের গভীর থেকে উঠে আসা এক অনুভূতির প্রতিধ্বনি। দক্ষিণ কোরিয়ান লেখিকা বেক সে হি তাঁর জীবনের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ, দ্বিধাগ্রস্ত, অথচ মানবিক মুহূর্তগুলোকে শব্দে রূপ দিয়েছিলেন। ৩৫ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু যেন সেই বইয়ের শেষ পাতায় লেখা এক নীরব বিদায়।
বেক সে হি ছিলেন একাধারে লেখক, আত্মজিজ্ঞাসাকারী এবং সাহসী কণ্ঠস্বর। তাঁর বই “I Want to Die But I Want to Eat Tteokbokki” প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে, যেখানে তিনি নিজের ডিস্টাইমিয়া (এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতা) নিয়ে মনোচিকিৎসকের সঙ্গে আলাপচারিতা তুলে ধরেন। বইটি কেবল কোরিয়ায় নয় বরং বিশ্বজুড়ে অনুবাদ হয়ে লাখো পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। তাঁর লেখায় ছিল এক ধরনের নীরব সাহস যেখানে মৃত্যু আকাঙ্ক্ষার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে জীবনের ছোট ছোট আনন্দ, যেমন ত্তোকবোক্কি খাওয়া।
বেকের মৃত্যু হয়েছে ২০২৫ সালের অক্টোবরে। মৃত্যুর কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না হলেও জানা গেছে, তিনি ব্রেইন ডেথের পর অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন এবং তাঁর অঙ্গদানের মাধ্যমে পাঁচজন মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে। কোরিয়ান অর্গান ডোনেশন এজেন্সি জানিয়েছে, তাঁর হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃত এবং দুটি কিডনি দান করা হয়েছে। মৃত্যুর প্রস্তুতিতে এমন মানবিক সিদ্ধান্ত যেন তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়েও অন্যের জন্য আশার আলো হয়ে রইল।
এই অঙ্গদান শুধু একটি চিকিৎসা বিষয় নয় বরং এটি তাঁর লেখার মতোই এক আত্মদর্শনের প্রকাশ। যিনি নিজের বিষণ্নতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলতেন, যিনি জানতেন জীবনের ভার কতটা কঠিন হতে পারে, তিনিই আবার মৃত্যুর মুহূর্তে অন্যের জীবন রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। এটি এক ধরনের নীরব বিপ্লব যেখানে আত্মকেন্দ্রিকতা নয় বরং সহমর্মিতা জয়ী হয়।
বেক সে হি’র মৃত্যু কোরিয়ায় এবং বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা আন্দোলনের জন্য এক বড় ধাক্কা। তাঁর লেখার মাধ্যমে অনেকেই প্রথমবার নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে সাহস পেয়েছেন। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠস্বর, যিনি বলতেন “তুমি একা নও, তোমার অনুভূতি বৈধ এবং তুমি বেঁচে থাকার যোগ্য।”
তাঁর ইংরেজি অনুবাদক অ্যান্টন হুর বলেছেন, “বেক শুধু লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক। তাঁর লেখার মাধ্যমে তিনি লাখো মানুষের জীবনে আলো এনেছেন।” তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড “I Want to Die But I Still Want to Eat Tteokbokki” ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি আরও গভীরভাবে আত্মজিজ্ঞাসা, সম্পর্ক এবং জীবনের অর্থ নিয়ে আলোচনা করেন।
এই লেখাটি শুধু একজন লেখকের মৃত্যু নয়, বরং একজন মানুষের জীবনের শেষ অধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা। বেক সে হি আমাদের শিখিয়ে গেছেন যে কেউ, যেকোনো অবস্থায়, অন্যের জন্য আশার আলো হতে পারে। তাঁর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, “আমি মরতে চাই” বলার পরেও “আমি ত্তোকবোক্কি খেতে চাই” বলার মতো জীবনের প্রতি আকর্ষণ রয়ে যায়। সেই আকর্ষণই হয়তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।