১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয়ের দ্বারপ্রান্ত। চারদিকে বাঙালির বিজয় নিশান উড়ছে। পাকিস্তানকে রক্ষায় মার্কিন-চীনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়, আর সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়ায়।
একই দিনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তৃতীয়বারের মতো ভেটো দেয় রাশিয়া। এই ভেটোর ফলে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ বিলম্বিত হলেও, স্বাধীনতার স্বপ্নকে আর কোনো বাধা দিতে পারে না।
তবে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী যখন পরাজয়প্রায়, তখন বুদ্ধিজীবী অপহরণের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৩ ডিসেম্বরের দিনে বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন আহমদ ও দৈনিক পূর্বদেশের শিফট ইনচার্জ এ এন গোলাম মোস্তফাকে বাসভবন থেকে আলশামস-আলবদর বাহিনী অপহরণ করে; তারা আর ফিরে আসেননি। এই সময়ে দেশের বেশির ভাগ এলাকা মুক্ত হয়ে যায়।
ঢাকার চূড়ান্ত দখলের প্রস্তুতি নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা এগোতে থাকে, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী ও এদেশীয় দোসররা বাঙালির নেতৃত্ব ও মেধা নাশের জন্য বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাংবাদিকদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা চালায়।
মিত্রবাহিনী যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে, কারণ তারা জানমালের ক্ষতি কমিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের দিকে নিয়ে যেতে চায়। বালীগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও থেকে বার্তা প্রধান কামাল লোহানী, আলী যাকের ও আলমগীর কবির ঘনঘন সংবাদ বুলেটিন সম্প্রচার করে চলেছেন। আজ থেকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
এই সময়ে নাজিরহাটে চতুর্থ বেঙ্গল চট্টগ্রামের দিকে এগোতে গিয়ে ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ইপিসিএফের অবস্থান স্থাপন করা হয়, যাদের সঙ্গে পাকবাহিনী ব্যাপক লড়াইয়ের পর পালিয়ে যায়। উত্তরে জেনারেল নাগরার বাহিনী ও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কালিয়াকৈর পর্যন্ত পৌঁছায়। ঢাকার শীতলক্ষ্য এলাকায় ২০-ইবি বাংলাদেশি বাহিনী পৌঁছায়, এবং ভারতীয় বাহিনী পূর্ব দিক থেকে প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
ঢাকা চূড়ান্ত লড়াইয়ের স্থল হওয়ায় সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা দ্রুত বাড়তে থাকে। ঢাকার আকাশ ভারতের বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় পাকিস্তানি সামরিক অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়ে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আশাও ব্যর্থ হয়।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিবৃতিতে জানান, জাতিসংঘের কর্মী, কূটনৈতিক ও বিদেশি নাগরিকদের নিরাপদ সরানোর জন্য সরকার সবরকম সহযোগিতা করবে। সাতক্ষীরায় বেসামরিক প্রশাসন কাজ শুরু করে। শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা গা-ঢাকা দেয়, তবে আলবদর চক্র সক্রিয় থাকে এবং দেশের প্রীতিসর্বস্ব সন্তানদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের বর্বরতা দেখায়।