বাংলাদেশে এডিস মশার বিস্তার ও ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন সারা বছরজুড়ে। একসময় মৌসুমি রোগ হিসেবে পরিচিত ডেঙ্গু এখন বারোমাসি আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এক মাসে সর্বোচ্চ। সেপ্টেম্বরে ৭৬ জন, জুলাইয়ে ৪১ জন এবং আগস্টে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই মারা গেছেন অন্তত ২০ জন। এই পরিস্থিতিকে অনেকেই ‘মহামারি’ বললেও সরকারিভাবে তা ঘোষণা করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারি ঘোষণা একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, যা রোগের বিস্তার, মৃত্যুহার, হাসপাতালের চাপ এবং আন্তর্জাতিক নির্দেশনার ওপর নির্ভর করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, স্বাভাবিক সীমা ছাড়িয়ে গেলে সেটি মহামারি হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারেও সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মহামারি ঘোষণা করেনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা অনেক কিছুই হালকাভাবে নিই। রাজনৈতিক কারণে সরকার মহামারি শব্দটি ব্যবহার করতে চায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, সুশাসনের অভাব এবং জবাবদিহির সংকট ডেঙ্গুর ভয়াবহতার মূল কারণ। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে।’
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন জনস্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা তৈরি করেছে। কিন্তু দায়িত্বশীলরা দায় নিতে চান না। ফগিং কার্যকর নয়, বরং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিপাতের ধরন বদলানোয় সারা বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। প্রতিরোধযোগ্য রোগে মৃত্যুকে গুরুত্ব না দেওয়া অগ্রহণযোগ্য।’
সরকারি রিপোর্টে পরিস্থিতির ভয়াবহতা পুরোপুরি উঠে আসে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্যের চেয়ে বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। ফলে ডেঙ্গু এখন ‘মরণব্যাধি’তে রূপ নিচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছি। মাঠপর্যায়ে ৭ জন পরিদর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি দাবি করেন, বিগত বছরের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। তবে একটি মৃত্যুও কাম্য নয়।
তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতি হাজারে ২.৩ জন কর্মী প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের রয়েছে প্রতি ১১ হাজারে একজন। জনবল সংকট সত্ত্বেও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। শুধু সিটি করপোরেশনের একক প্রচেষ্টায় নয়, জনগণের সচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’