বাংলাদেশে মৌসুম শেষ হলেও ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহতা কমছে না। নভেম্বরের প্রথম ১৫ দিনেই এডিস মশার কামড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৩ জন, আর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ১৪ হাজার মানুষ। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে।
রাজধানীর রামপুরায় বসবাসকারী সাইফুল ইসলাম (৩২) বর্তমানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি জানান, তার পরিবারের তিনজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। একই অ্যাপার্টমেন্টের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কেউ না কেউ আক্রান্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে—তিনজন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং দুজন ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে। একই সময়ে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৭৯২ জন রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ধরণ পাল্টে গেছে। ফলে এডিস মশার প্রজনন চক্র দীর্ঘ হয়েছে। আগে ডেঙ্গু মূলত বর্ষাকালে সীমিত থাকলেও এখন সারা বছরই ঝুঁকি তৈরি করছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, নগরায়ণের প্রভাবে এডিস মশা গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। জমে থাকা পানি, ঝোপঝাড় ও অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মশার বিস্তার দ্রুত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মশার ধরনগত পরিবর্তন ঘটছে জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। ফলে সংক্রমণও দ্রুত ও অনির্ধারিত হচ্ছে। ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ রয়েছে, প্রতি বছর একই ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ভাইরাস দ্রুত মিউটেশন ঘটাতে পারে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১০,৪৯৬ জন রোগী, মৃত্যু হয়েছিল ৩৯ জনের। সেপ্টেম্বরে ভর্তি বেড়ে দাঁড়ায় ১৫,৮৬৬ জনে, মৃত্যু হয় ৭৬ জনের। অক্টোবরে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২২,৫২০ জনে, মৃত্যু হয় ৮০ জনের। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়েই মৃত্যু ছাড়িয়েছে ৩৩০ জন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গুকে মৌসুমি রোগ হিসেবে ভাবলে চলবে না। এটি এখন সারা বছরের সমস্যা। মশক নিধন কার্যক্রমে ঘাটতি থাকায় নিয়ন্ত্রণে আসছে না এডিস মশা। তিনি সতর্ক করে বলেন, শুধু কীটনাশকের ধোঁয়া বা স্প্রে দিয়ে মশার প্রজনন রোধ সম্ভব নয়। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়।
ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, বরং সারা বছরের আতঙ্ক। জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ ও মশক নিধনে দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই শহর থেকে গ্রাম—সব জায়গায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।