সর্বশেষ

হাসপাতালে শয্যাসংকট

বছরে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৪ লাখের বেশি রোগী

প্রকাশিত: ৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:০২
বছরে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৪ লাখের বেশি রোগী

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২ হাজার রোগী শয্যা না পেয়ে হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেই হিসাবে বছরে অন্তত ৪৪ লাখ রোগীকে অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ পরিবেশে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। অথচ একই সময়ে শয্যার অভাবে আরও কয়েক হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগই পাচ্ছেন না।

 

ঢাকা মেডিক্যালে প্রতিদিন দুই হাজার রোগী মেঝেতে

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যালে একই চিত্র। বিভাগীয় মেডিক্যাল কলেজগুলোতে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার এবং অন্যান্য মেডিক্যালে অন্তত এক হাজার রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন।

 

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, প্রতিদিন দেশে অন্তত ১৫ হাজার রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নেন। সেই হিসাবে বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫৪ লাখ ৩৫ হাজার। আরও অন্তত ১০ লাখ রোগী শয্যা সংকটের কারণে ভর্তি হতে পারেন না। তাঁর মতে, মানসম্পন্ন চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে অবিলম্বে অন্তত ১৫ হাজার নতুন শয্যা যোগ করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন ২০ হাজার কোটি টাকা।

 

 

শয্যাসংখ্যা বেড়েছে, তবু সংকট বাড়ছে

 

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৬৬০টিতে। বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ৯৯ হাজার ৯৭৫টি। তবু শয্যাসংকট কাটছে না। কারণ, উপজেলা পর্যায়ে অনেক হাসপাতাল ফাঁকা থাকলেও বড় শহর ও রাজধানীতে রোগীর চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অন্তত ২০টি জেলায় প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য গড়ে দুটি শয্যাও বরাদ্দ নেই। শেরপুরে সবচেয়ে কম ১.৩০টি শয্যা, এরপর লক্ষ্মীপুরে ১.৪৪, নরসিংদীতে ১.৪৯, হবিগঞ্জে ১.৫০, গাজীপুরে ১.৫৬, সিরাজগঞ্জে ১.৫৮, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১.৬১, নাটোরে ১.৬২, গাইবান্ধায় ১.৬৩ এবং চুয়াডাঙ্গায় ১.৬৬ শয্যা রয়েছে।

 

সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে

 

চিকিৎসকরা বলছেন, মেঝে বা করিডরে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা গুরুতর সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনফেকশন কন্ট্রোল কমিটির সদস্যসচিব ডা. কাকলী হালদার জানান, মেঝে ও করিডর জীবাণুমুক্ত করার সুযোগ থাকে না। ফলে এমআরএসএ ও ইএসবিএল-এর মতো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু রোগীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এতে রোগীরা হাসপাতাল থেকে নতুন রোগে আক্রান্ত হয়ে ফেরেন, চিকিৎসা ব্যয় ও মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ে।

 

প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা অপরিহার্য

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল শয্যা বাড়িয়ে সংকট সমাধান সম্ভব নয়। প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবায় জোর না দিলে হাসপাতালের ওপর চাপ বাড়তেই থাকবে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ ও সঠিক রেফারেল পদ্ধতি না থাকায় ঢাকায় রোগীর চাপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।

 

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, অতীতে বাংলাদেশ ফাইলেরিয়া, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ ও জলাতঙ্ক প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল। আবার সেই অভিজ্ঞতাই কাজে লাগাতে হবে।

 

অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। উপজেলা পর্যায়ে শয্যা ফাঁকা থাকলেও রোগীরা ঢাকায় আসেন। সঠিক রেফারেল সিস্টেম চালু না হলে এই সংকট কাটবে না।

 

সংস্কার সুপারিশ গুরুত্ব পাচ্ছে না

 

স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ৭০ শতাংশ সেবা বেসরকারি খাতে চলে গেছে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় জোর দেওয়া ও সরকারি খাতকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। কিন্তু এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু শয্যা বৃদ্ধি নয়, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, নৈতিক সংস্কার এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া সংকট সমাধান সম্ভব নয়। অন্যথায় প্রতিবছর লাখো রোগী হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হবেন এবং সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়বেন।

সব খবর