কবি, গবেষক ও তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার অভিযোগ করেছেন যে জুলাই আন্দোলনের ফল হিসেবে ক্ষমতায় এলেও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জনগণের সঙ্গে না থেকে সেনাবাহিনী ও আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে ‘আঁতাত’ করেছেন। তার দাবি, জুলাই-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইউনূস সরকারের কার্যক্রম জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এতে দেশ আরও অস্থিরতার দিকে ধাবিত হয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনামূলক অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’-এ অংশ নিয়ে তিনি বলেন, “অভ্যুত্থান জনগণ করেছে, কোনও রাজনৈতিক দল না। তাহলে তিনি (ইউনূস) কেন রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্র করছেন? এরা তো লুটেরা মাফিয়া শ্রেণি।” তিনি অভিযোগ করেন, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রশ্নে ইউনূস কোনও মৌলিক উদ্যোগ নেননি; বরং নির্বাচন ঘোষণা করে ‘উগ্র ধর্মবাদী’ শক্তির উত্থানের ঝুঁকি তৈরি করেছেন।
ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও রাজনৈতিক সংকট
ফরহাদ মজহার অভিযোগ করেন যে জুলাই সহিংসতার পর দেশে ‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং মাজার ভাঙা, বাউলদের ওপর হামলা, কবর থেকে লাশ উত্তোলনের মতো ঘটনাগুলো এই প্রবণতার প্রকাশ। তার ভাষ্য, “সেক্যুলার ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ একই মুদ্রার দুই পিঠ। এখন ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ মোকাবেলা করাই প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য।”
তিনি আরও বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই উগ্রতা মোকাবেলায় ব্যর্থ এবং আইন প্রয়োগে ‘অজ্ঞতা’ প্রদর্শন করছে। “আমাকে দাড়ি চেঁছে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা এসব বলছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না,”—অভিযোগ করেন তিনি।
ইউনূসের সিদ্ধান্তকে ‘মারাত্মক ভুল’
ইউনূসের প্রতি সমালোচনা তুলে ধরে ফরহাদ মজহার বলেন, “তিনি জনগণের সঙ্গে নয়, সেনাবাহিনী, আন্তর্জাতিক পরাশক্তি এবং লুটেরা শ্রেণির সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। এটা আমাদের প্রত্যাশিত ছিল না।”
তিনি দাবি করেন, বর্তমান সরকারকে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন লাগবে এবং নির্বাচন সেই উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে।
নির্বাচনের বিপক্ষে নন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা যে নির্বাচন চাই, তা হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন। যাতে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সংবিধান নিয়ে প্রকৃত আলোচনা হতে পারে।”
উগ্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের ডাক
বাউল ও সঙ্গীতশিল্পীদের ওপর হামলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসলামে ‘গান হারাম’—এই দাবি অজ্ঞতাপ্রসূত। “আজানে যে রাগ ব্যবহার হয়, সেটাও তো সংগীত। ইসলামে হারাম হলো সেই সবকিছু, যা মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়; গান নিজে হারাম নয়,”—মন্তব্য করেন তিনি।
মাদ্রাসাভিত্তিক ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও দর্শন না জেনে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেওয়া রাষ্ট্রের জন্য ‘বিপদজনক’। তার মতে, উগ্র শক্তিকে মোকাবেলা করতে আইন নয়, দরকার সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ।
হেফাজতের অবস্থান নিয়ে বিস্ময়
২০১৩ সালে হেফাজতের পক্ষে অবস্থান নিলেও বর্তমান সময়ে তাদের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, “তারা আগের ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মানুষের ওপর জুলুম করেছিল। আজ আবার বাউলদের বিরুদ্ধে নেমেছে। এতে অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে।”
হেফাজত শেখ হাসিনাকে ‘পুনর্বাসনের রাজনীতি’ করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারের ওপর আস্থা সংকট
ফরহাদ মজহার মনে করেন, উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বর্তমান সরকারের ‘দুর্বলতা’ ও ‘নৈরাজ্য’ মোকাবেলায় অক্ষমতার ফল। তিনি বলেন, “জনগণকে উপেক্ষা করার কুফলই আজ আমরা সবাই ভোগ করছি। রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গঠনের যে সুযোগ এসেছিল, তা নষ্ট করা হয়েছে।”
তিনি বারবারই উল্লেখ করেন যে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সরকারকে জনগণের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। “অন্যথায় উগ্রতা ও সহিংসতা আরও বাড়বে,”—সতর্ক করেন তিনি।