সর্বশেষ

বেগুনের বাম্পার ফলন ও জাতীয় নীরবতার চাষাবাদ

প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩০
বেগুনের বাম্পার ফলন ও জাতীয় নীরবতার চাষাবাদ

বিটিভি, বাংলাদেশ টেলিভিশন, দেশের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল। বাংলাদেশে যতই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা ঘটুক, সেটা যদি সরকারের জন্য অনুকূল না হয়, সরকারের জন্য অস্বস্তিকর হয়, সে ঘটনা এই চ্যানেলে ঠাই পায় না। এ এক পুরোনো, পরীক্ষিত সত্য। চ্যানেলটা তখনো ব্যস্ত থাকে তার নিয়মিত কার্যক্রম নিয়ে। কৃষিপ্রধান দেশের ‘প্রাণ’ কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান নিয়ে। বিটিভির পর্দায় তখন যেন আরও বেশি করে প্রাণ পায় শস্যের মাঠ, খামারির হাসি আর কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার কণ্ঠ। তার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র যেন বলে, দেশে অস্বাভাবিক কিছুই হচ্ছে না। সব ঠিক আছে। দেখুন, কেমন বেগুনের বাম্পার ফলন হয়েছে।

 

না, ওসব সময়ে বিটিভিতে দিনরাত কেবল বেগুনের বাম্পার ফলন দেখানো হয় না। ধান, গম, পাট, পটল, লাউ, কুমড়া, শসা, পেঁপে, হাঁস, মুরগি, মাছ, চিংড়ি, গরু, ছাগল—সব নিয়েই অনুষ্ঠান চলে। কিন্তু নাম হয় কেবল বেগুনের। এতো কিছুর ভিড়ে “বেগুনের বাম্পার ফলন”ই হয়ে উঠেছে হাস্যরসিক বাঙালির রাজনৈতিক পরিভাষা। কিন্তু কেন? সব থাকতে বেগুনই কেন?

 

প্রথম কারণটা ভাষাগত। “বেগুন” নামটার মধ্যেই এক নির্মম কৌতুক লুকিয়ে আছে। বাঙালি কানে শুনলেই মনে হয় বে-গুণ, যার কোনো গুণ নাই। বাস্তবে অবশ্য ভাষাবিদরা বলবেন, শব্দটার উৎস সংস্কৃত শব্দ বাতিঙ্গন। ফলে এ নামের সঙ্গে ‘গুণ’-এর কোনো সম্পর্ক নেই। আরও গভীরে গেলে, শব্দটার শিকড় প্রত্ন-দ্রাবিড়ীয় ভাষাতেও খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ বেগুন নামের সবজি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন খাদ্যসংস্কৃতির অংশ। এমনকি রামায়ণ-মহাভারতেও বেগুনের উল্লেখ পাওয়া যায়। চাষ করা সবজি হিসেবেই। মানে, বেগুন আমাদের হেঁশেলে ঢুকেছে এই জনপদে সভ্যতার শুরুর থেকেই।

 

কিন্তু ভাষা কখনো অভিধান দেখে চলে না। মানুষ শব্দ ব্যবহার করে নিজের মতো করে। ব্যঙ্গ-পরিহাস করতে গেলে তো আরো এক কাঠি বেশি। তাই বাঙালির লোকজ ব্যাখ্যা বলে, বেগুন মানে বে-গুণ। অথচ পুষ্টিগুণের দিক থেকে যে কথাটা কতটা ভুল, সেটা সবাই জানে। কিন্তু ব্যঙ্গের জন্য সত্যের দরকার হয় না, দরকার হয় শ্রুতিভ্রমের। আর সেখানেই বেগুন নামটার সার্থকতা। যার নামই তাকে সন্দেহজনক করে তোলে। যেন শুরুতেই বলে দেয়, আমি রঙ্গ-পরিহাসের বিষয়, আমাকে গুরুত্ব সহকারে নিও না।

 

বেগুনের এই রঙ্গ-প্রবণতা কেবল নামেই সীমাবদ্ধ নয়। তাকে নিয়ে বাঙালি বিদঘুটে সব বাগধারাও বানিয়েছে। এই যেমন যখনই কেউ মুখ গোমড়া করে বসে থাকে, অন্যরা তাকে গিয়ে বলে, বেগুনের মতো মুখ করে বসে থেকো না তো! ওদিকে পোড়া বেগুনের ভর্তা খাবার পাতে দারুণ উপাদেয়। অথচ সেই বেগুন পোড়াই যখন কোনো কাজের সাথে বসানো যায়, অমনি তার দফারফা সাড়া। এমনভাবে ঘেঁটে যায়, আর তা থেকে কিচ্ছু উদ্ধারের উপায় থাকে না।

 

খেয়াল করে দেখুন, বেগুন নিয়ে এই দুটি বাগধারাতেই বেগুন দিয়ে খারাপ অবস্থা বোঝানো হয়েছে। কেবল খারাপ নয়, ভীষণই খারাপ, নিতান্ত করুণ, হাস্যকর অবস্থা। সোজা কথায় বেগুনকে ব্যবহার করা হয়েছে অপমান করতেই। অথচ বাঙালির বাস্তব ঘরোয়া জীবনে বেগুনের অবস্থান ঠিক উল্টো। এই নিরীহ সবজি ছাড়া এক সপ্তাহ বাঙালির রান্নাঘর চলবে? অসম্ভব! তাই তো দ্বিজ কানাই যখন হুমরা বেদেকে নয়া বাড়িতে বসাচ্ছিলেন, প্রথমেই তাকে দিয়ে উঠানে বেগুনের চাষ করান। 

 

নয়া বাড়ি লইয়া রে বাইদ্যা লাগাইলো বাইঙ্গন।
সে বাইঙ্গন তুলতে কইন্যা জুড়িলো কাইন্দন।।

(দ্বিজ কানাই, মহুয়া, ময়মনসিংহ গীতিকা)

 

নতুন অঞ্চলে এসে বাপ-বেটিতে নতুন বসত গড়ছে। তার জন্য প্রথমেই লাগাল বেগুন। তারপর লাগাল কচু, লাগাল কলা, মারল হাঁস, মারল কইতর, মারল ময়না-টিয়া। অর্থাৎ, বাঙালি ঘরকন্নার শুরুতেই বেগুন। ভুলে যাবেন না, এটা রাজা-রাজড়াদের আনুকূল্যে লেখা গাঁথা নয়, একেবারেই মাটির সোঁদা গন্ধওয়ালা লোকগাঁথা। মানুষের মাঝেই তার বিস্তৃতি। আর সেখানে যখন প্রথমেই বেগুন আসে, সেটাই বলে দেয়, এই নিরীহ দর্শন সবজি বাঙালি জীবনের কত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 

বেগুনকে বলতে পারেন বাঙালি রান্নাঘরের ‘আলু’। সব রান্নায় মানিয়ে যায়। বানানো যায় তরকারি, ভর্তা, বা ভাজি। মাছের ঝোলেও চলে, মাংসের সাথেও চলে। দিতে পারেন ডিমের সালুন, বা ডিম ভাজিতে। এমনকি দেয়া যায় অন্য সবজির তরকারিতেও। শুধু কি তাই, বাঙালির ইফতার বেগুনি ছাড়া অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আরও মজার বিষয় হলো, বাঙালি বেগুন ছাড়াও বেগুনি বানাতে পারে! পেঁপে দিয়ে, কুমড়া দিয়ে, আলু দিয়ে, কলা দিয়ে, এমনকি মরিচ দিয়েও। মানে, সেখানে বেগুনের ধারণাটাই জরুরি, বেগুন নয়।

 

এখানেই ব্যঙ্গটা তীব্র হয়ে ওঠে। টিভিতে বেগুনের বাম্পার ফলন দেখানোর বিষয়টাও তাই। বেগুন থাক বা না থাক, বেগুনী চলবেই। ফলে এখানে রঙ্গ-পরিহাসের আড়ালে বেগুন হয়ে ওঠে অস্বীকারের প্রতীক। যা আছে, কিন্তু তা নিয়ে কথা বলা হচ্ছে না। যা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এবং এই কৌতুকটা কেবল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল নিয়ে প্রচলিত হলেও, তা কিন্তু কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রেই সীমাবদ্ধ না।

 

এইখানেই আহমদ ছফা এসে পড়েন। স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবীদের একজন। সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী। ঢাকার সত্তর থেকে নব্বই দশকের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীদের তিনি কোনো না কোনো সময়ে ‘লালন’ করেছেন বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। ঐ সময়ে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে তার প্রভাব ছিল এতোটাই। অথচ তার নিজের রাজনৈতিক পথচলা ছিল দ্বিধাজর্জর। জাসদের সঙ্গে তার গাঁটছড়া নিয়ে তিনি পরে নিজেই বলেছিলেন, ওটা একটা ‘রাজনৈতিক ভুল’ ছিল। সত্তরের দশক, আশির দশক জুড়ে তিনি যাদের পক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, যাদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন—বাংলার মানুষকে, তিনি নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। বারবার। আর তখনই তিনি উদ্ধার করলেন—একটা বেগুনের চারা।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেগুন চাষ। শুনতেই কী হাস্যকর শোনায়! অথচ সেই কাজটাই বিপুল উদ্যমে করেন আহমদ ছফা। শুধু তাই নয়, সে অধ্যায় তার পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ-এ হয়ে উঠেছে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যেটা নিজের মূল্যায়নে তার সেরা কাজ। “আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্য।” সে দাবি যে কোনো ছফা-পাঠককেই অবাক করার কথা। ওঙ্কারনিহত নক্ষত্র থাকতে কেন এই বইকে তিনি সেরা বললেন? কারণ সম্ভবত—ওটা তার আত্মজীবনীমূলক রচনা। এখানে তিনি নিজের গল্প বলেছেন, নিজেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তার ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’—তার এই আপ্তবাক্য ছেড়ে নিজের চাষ করা বেগুন, নিজের পোষা টিয়া পাখির গল্প বলেছেন। বেগুন এখানে প্রতিরোধ নয়, বিপ্লব নয়—প্রত্যাহার।

 

ঠিক এখান থেকেই আমাদের আসা দরকার বর্তমানে। আহমদ ছফার উত্তরসূরীদের কাছে। গত দেড় বছরে বাংলাদেশে যা যা ঘটেছে, সেগুলোর কোনো একটা যদি আগের সরকারের সময় ঘটত, আহমদ ছফার উত্তরসূরী বুদ্ধিজীবীরা কী করতেন? আজকের মতো চুপ করে থাকতেন?

 

না, কোনো সরকারের সময়ই এমন ঘটনা কাম্য নয়। তাই এর প্রতিবাদও সব সরকারের সময়েই সমান উচ্চকণ্ঠে হওয়া জরুরি। বিশেষ করে যখন দেশে ‘অনিয়মিত’ রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলে, তখন বুদ্ধিজীবীদের দায় আরো বেড়ে যায়। তখন যদি আহমদ ছফার উত্তরসূরীরা বেগুন চাষে ব্যস্ত হয়ে পরেন, সেটা সরাসরি দেশের সাথে, দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। 

 

অবশ্য এটা তাদের নতুন কোনো বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ না। এবারই এমনটা প্রথম দেখা গেল তা নয়। মুক্তিযুদ্ধটাই বোধহয় এর বিপরীতে এক অনন্য ব্যতিক্রম ছিল। শিক্ষিত বাঙালির, বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর এটাই সম্ভবত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। সংঘর্ষ এলে—বেগুন। অস্বস্তি এলে—বেগুন। নৈতিক সিদ্ধান্তের সময় এলে—বেগুন। ফলে তাদের থেকে এরচেয়ে বেশি আশা করাটাই হয়তো বোকামি। 

 

তাই কামনা একটাই—যেহেতু বেগুন চাষই হচ্ছে, অন্তত ফলনটা বাম্পার হোক।

সব খবর