দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা মামলাকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ ও ক্ষোভ বাড়ছে। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এই হামলাকে স্বাধীন সাংবাদিকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং আইনের শাসনের ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখছেন। মামলার এজাহারে ঘটনাটিকে ‘পরিকল্পিত হামলা’ বলা হলেও বিপুল সংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি অন্তর্ভুক্ত করায় তদন্তের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রাজধানীর কাওরান বাজারে প্রথম আলো ভবনে গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় রবিবার (২১ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১২টার পর তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করা হয়। প্রথম আলোর হেড অব সিকিউরিটি মেজর (অব.) মো. সাজ্জাদুল কবির বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের একাধিক ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এতে ৪০০ থেকে ৫০০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
একই ধরনের অভিযোগে দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় পৃথক মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে।
তবে মামলায় বিপুল সংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে সতর্ক করেছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা। দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিক জায়মা ইসলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে বলেন, অতীতে এ ধরনের মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহারের নজির রয়েছে। তিনি নিরপরাধ কেউ যেন গ্রেফতার না হয় এবং গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে আইনসম্মত আচরণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে প্রমাণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দিকে আঙুল না তুলতে সাংবাদিকদের সতর্ক করেন।
এই হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে নারাজ বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশ। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যু ঘিরে প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার ও একাধিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক ও আদর্শিক উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত দেখছেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের শিক্ষক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, ওসমান হাদির ওপর আক্রমণ থেকে তার মৃত্যুর সংবাদ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মিলিয়ে দেখলে পরিকল্পিত উসকানির চিত্র স্পষ্ট হতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মামলার এজাহারে বলা হয়, হামলাকারীরা দেশীয় অস্ত্র ও দাহ্য পদার্থ নিয়ে মিছিল করে এসে হামলার চেষ্টা চালায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি দিয়ে লোক জড়ো করে। মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশ্লেষক রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, মব সহিংসতা কীভাবে সংগঠিত হলো, কারা পরিকল্পনা করলো এবং উসকানি দিল তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা জরুরি। একই সঙ্গে দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার মূল্যায়নও প্রয়োজন।
তবে পুলিশের দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের কোনো ঘাটতি ছিল না। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, সরাসরি গুলি চালালে প্রাণহানির ঝুঁকি থাকায় সংযম দেখানো হয়েছে। পুলিশ এখন পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে বলে তিনি জানান।
হামলার পর প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, গানম্যান নিয়োগের পাশাপাশি বাসভবনের নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সহিংসতা বা অগ্নিসংযোগ করে মতের জবাব দেওয়া গণতন্ত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটি শুধু গণমাধ্যম নয়, গণতন্ত্রের ওপর আঘাত। জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দাবি করেন, সরকারের ভেতরের একটি অংশের মদদ ছাড়া এত বড় হামলা সম্ভব নয়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এসব ঘটনা মুক্তচিন্তা ও ভিন্নমত দমনের পরিকল্পিত চিত্র, যার দায় এড়াতে পারে না সরকার।
বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও বড় ঝুঁকির মুখে পড়বে।