অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁদের দাবি, “মবের কারণে সবাই ভীত”— এমনকি আদালত, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরাও নিরাপদ নন। দ্রুত সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
বুধবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে “হিউম্যান রাইটস ইন ট্রানজিশন” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব মত দেন আলোচকরা। সভাটির আয়োজন করে মানবাধিকার সংস্থা সকল প্রাণের নিরাপত্তা (সপ্রান)।
উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান
সভায় সপ্রানের গবেষক অপ্সরা ইসলাম তন্দ্রা উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে জানান, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৪৯৬টি। একই সময়ে ২,৮৭৮টি খুন, ১৯৫টি মব সহিংসতা, ৩৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর হামলা, ৬৪০টি শিশু নির্যাতন এবং ৩৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ৪৫ জন নিহত ও ৩০০ জন আহত হয়েছেন; সীমান্তে ৩৪টি হত্যাকাণ্ড এবং ভারত থেকে দুই হাজারের বেশি পুশ ইন ঘটেছে।
অপ্সরা ইসলাম জানান, প্রতিবেদনের সব তথ্য দেশের মূলধারার গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে সংগৃহীত।
সরকারের পাল্টা মন্তব্য
বৈঠকে উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “এই প্রতিবেদনগুলো তৈরি হয় সংবাদপত্রের খবরের ভিত্তিতে, কিন্তু অনেক সময় এসব প্রতিবেদনের উৎস ও নির্ভুলতা যাচাই করা হয় না। গণমাধ্যমে সবসময় পর্যাপ্ত সময় ও সম্পদ থাকে না।”
তিনি আরও দাবি করেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি “স্থিতিশীল” এবং “গণমাধ্যমে যেভাবে তুলে ধরা হয়, বাস্তবে অবস্থা তার চেয়ে অনেক ভালো।”
সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার পেছনে ফেসবুকের ভূমিকা নিয়েও সতর্ক করেন তিনি। “রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জ—এসব জায়গায় ফেসবুক থেকেই সহিংসতার সূচনা হয়েছে,” বলেন শফিকুল আলম।
“মবের কারণে সবাই ভীত”
গুম কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, “এখনকার পরিস্থিতিতে মবের কারণে সবাই ভীত, এমনকি আদালতও। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখুন—আদালতে ডিম ছোড়া, লাথি মারা, এমনকি বিচারকের রুমে ঢোকা পর্যন্ত হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আগে ভয় ছিল র্যাব বা গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে; এখন ভয় হচ্ছে, রাস্তায় কিছু মানুষ জড়ো হয়ে আমাকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে না দেয়!”
নূর খান দ্রুত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। “রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই দায়িত্ব নেওয়া উচিত, অন্তর্বর্তী সরকার নয়,” বলেন তিনি।
“মানবাধিকার সংকট পুরোনো, তবে নতুন রূপে”
মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেন, “আমরা অনেকদিন ধরে আগস্ট ২০২৪-এর আগের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর যে পরিবর্তন এসেছে, তা নিয়েও আলোচনা জরুরি।” তিনি জানান, এখনো জেলে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে।
আরেক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার না করে যেসব বাহিনীকে দায়ী করা হয়, সেই বাহিনীকেই আমরা এখন নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দিচ্ছি। এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর হচ্ছে।”
সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ এম শাহান, বিএনপির গবেষক সাইমুম পারভেজ, এবং আইনজীবী মানজুর আল মতিন।