বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজনন ও জীবনচক্র মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত পাঁচ বছরে ইলিশ আহরণ প্রায় ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে মাছটির দাম স্বল্পআয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) জানিয়েছে, ইলিশ উৎপাদন হ্রাসের পেছনে রয়েছে দুটি প্রধান কারণ—প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও মানবসৃষ্ট চাপ। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে নদীর নাব্যতা হ্রাস, দূষণ, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং অভিবাসন রুটে প্রতিবন্ধকতা। মানবসৃষ্ট সমস্যার মধ্যে রয়েছে অবৈধ ট্রলিং, মা ইলিশ ও জাটকা ধরা এবং নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানান, ২০২০–২১ থেকে ২০২৪–২৫ পর্যন্ত ইলিশ আহরণ ক্রমাগত কমেছে। চলতি বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে ইলিশ আহরণ ২০২৪ সালের তুলনায় যথাক্রমে ৩৩.২০% ও ৪৭.৩১% কম হয়েছে। দুই মাসে আহরণ হয়েছে ৩৫,৯৯৩.৫০ মেট্রিক টন, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩৯% কম।
বিএফআরআই-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালের নিষেধাজ্ঞার ফলে ৫২.৫% মা ইলিশ নিরাপদে ডিম ছেড়েছিল, যা থেকে ৪৪.২৫ হাজার কোটি জাটকা উৎপন্ন হয়। কিন্তু ডিম পাড়ার হার বাড়লেও উৎপাদন বাড়েনি সমান হারে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ডিম পাড়ার হার ১১% বাড়লেও ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৬%।
বিজ্ঞানীরা জানান, ইলিশ একটি পরিযায়ী মাছ, যা প্রজননের জন্য সমুদ্র থেকে নদীতে আসে এবং ডিম ছাড়ার পর জাটকা বড় হয়ে আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। এই চক্র সফলভাবে সম্পন্ন করতে বাধাহীন নদীপথ প্রয়োজন। কিন্তু মেঘনা, তেঁতুলিয়া, দৌলতখান ও চাঁদপুর অঞ্চলে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে, যা মা ইলিশের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে।
চাঁদপুর, ভোলা, পটুয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন চর এলাকায় নদীর নাব্যতা হ্রাস ও দূষণের কারণে ইলিশের প্রজননক্ষেত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শীতকালে পানির মান দ্রুত নষ্ট হয়, অক্সিজেন কমে যায় এবং অ্যামোনিয়ার ঘনত্ব বেড়ে যায়, যা মাছের জন্য বিষাক্ত। শিল্প বর্জ্য, কৃষি রাসায়নিক ও নগরবর্জ্য নদীতে মিশে পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে।
চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, “ইলিশের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে হলে অভিবাসন রুট সংরক্ষণ, নদীর নাব্যতা রক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ ট্রলিং ও জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।” তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর গুরুত্ব দেন।