সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যর্থতার পর এবার স্থলভাগে (অনশোর) বিদেশি কোম্পানির কাছে গ্যাস ব্লক ইজারা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গ্যাস উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) চূড়ান্ত করতে পেট্রোবাংলা জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে নির্বাচনের আগে এমন সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দেশে গ্যাসের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় সরকার নতুন কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য স্থলভাগের সমতল ও পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দরপত্র আহ্বান করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে নতুন পিএসসির খসড়া চূড়ান্ত করে তা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
নতুন চুক্তিতে গ্যাসের দাম অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ব্রেন্ট ক্রুড) সঙ্গে সমন্বয় করে নির্ধারণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এতে প্রতি ব্যারেল তেলের দামের ৮.৫ শতাংশ হিসেবে গ্যাসের দাম নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ, যদি ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার হয়, তাহলে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম হবে ৮.৫ ডলার। বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ছিল ৬৬.১০ ডলার, সে হিসাবে গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ৫.৬১ ডলার। বর্তমানে পেট্রোবাংলা শেভরনসহ বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস আড়াই থেকে তিন ডলারে কিনে থাকে। নতুন পিএসসি কার্যকর হলে গ্যাসের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শোয়েব বলেন, “নতুন পিএসসি আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সরকারের অনুমোদন পেলে চলতি বছরের মধ্যেই দরপত্র আহ্বান সম্ভব। তবে সাগরের তুলনায় স্থলভাগের গ্যাসের দাম কম থাকবে।”
অন্যদিকে, জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এই উদ্যোগকে অবাস্তব ও ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভুল বার্তা দেবে। ইতোমধ্যেই সার ও শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এবার স্থলভাগেও বিদেশি কোম্পানির হাতে গ্যাস তুলে দিলে উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “গ্যাস ঘাটতি পূরণের জন্য ইতিমধ্যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এখন অনশোরের গ্যাস আন্তর্জাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া মানে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া।”
বাপেক্সকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের মাধ্যমে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু জ্বালানি বিভাগ সেটি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশিদের পাশাপাশি বাপেক্সকেও প্রতিযোগিতার সুযোগ দিতে হবে।”
বর্তমানে দেশে ২২টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন ১৮০০ থেকে ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হচ্ছে। এর বাইরে ভোলার দুটি গ্যাসক্ষেত্র স্থানীয়ভাবে গ্যাস ব্যবহার করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেটের পর দেশের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে ভোলা ও বরিশাল অঞ্চল হতে পারে গ্যাসের নতুন হাব। তবে বাপেক্স শরীয়তপুরে খনন করে ব্যর্থ হয়েছে, আর সুন্দরবনে শেভরনও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক কিছু পায়নি।
শতবর্ষ পুরোনো ইতিহাস বলছে, পাহাড়ে অনুসন্ধানেও তেমন সাফল্য আসেনি। ১৯১৪ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে প্রথম কূপ খনন করে বার্মা ওয়েল কোম্পানি, কিন্তু গ্যাস পাওয়া যায়নি। পরবর্তী ১২টি কূপেও একই ব্যর্থতা।
সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি কোম্পানির হাতে স্থলভাগের গ্যাস তুলে দেওয়া দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।